যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
যেহেতু ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, তাই রাজনীতির গতি প্রকৃতি কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারতাম। মার্চের শুরু থেকেই দেশের সার্বিক রাজনীতিক অবস্থা চরম অস্থিরতার মধ্যে ছিল। ২৫ মার্চ কালো রাতের হানাদার বাহিনীর দানবীয় হত্যাকাণ্ডের পরই ২৬ মার্চ শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রথম দিকেই কিশোরগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মনপাড়া গ্রামের বাড়িতে চলে আসি আমরা। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মন আনচান করতেছে। কিন্তু কিভাবে যাব ,কে নিবে এগুলো নিজে নিজে ভাবছিলাম সারাক্ষণ। এপ্রিলের মধ্য ভাগে আমার চাচাতো ভাই ড.এরশাদ উল্লাহ ও ফুফাতো ভাই শহিদ আলমগীর যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য আমাকে সাহস যোগান,অনুপ্রেরণা দেন এবং যাওয়ার কলাকৌশল শিখিয়ে দেন। এরপর সমমনা লোক সংগ্রহ করতে করতে কেটে যায় আরো দুই মাস। জুলাই মাসের প্রথমে বন্ধু আনোয়ার,হারুন,মিজান,ফুল মিয়াসহ আমরা আরো বেশ কয়েকজন বাড়ি থেকে পালিয়ে মন্দভাগ দিয়ে ভারতের ত্রপুরা রাজ্যে চলে যাই। যেতে যেতে রাত হয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সীমান্তবর্তী একটি ক্যাম্পে যাই। কিন্তু কপাল খারাপ। ক্যাম্প থেকে বলল, এখানে থাকার মতো জায়গায় নেই। তাই কোন উপায় না পেয়ে রাতে গোল চত্ত্বরের খোলা আকাশেই শুয়ে,বসে কাটিয়ে দেই। পরদিন আমরা যাই কংগ্রেস ভবনের শরণার্থী শিবিরে। এখানে আমাদের মিরপুর এলাকার খসরু ভাইয়ের এক আত্মীয় আবদুল লতিফ আমাদের পরিচয় পেয়ে ক্যাম্পে ভর্তি করতে সহায়তা করে।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
কংগ্রেস ভবনের শরণার্থী শিবিরে কয়েক দিন থাকার পর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো গোকল নগর ক্যাম্পো।এরপর চৌধুরীপাড়া ক্যাম্পে যাই। এখানে ১৫/২০ দিন আমাদের পিটি করানো হয়েছে। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আমাদের এমপি আমির হোসেন। গোকল নগর ক্যাম্পে দুট্ িবিভাগ ছিল। পদ্মা ও মেঘনা নামে।এই দুই বিভাগে প্রায় ১৮শ মুক্তিযোদ্ধাকে এক মাস প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। রাইফেল,হ্যান্ড গ্রেনেড,এসএলআরসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন প্রদান করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
পদ্মা ও মেঘনা আমাদের এই দুই ক্যাম্পের ১৮শ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট। আগস্ট মাসের শেষ দিকে আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করতে আসেন মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী । আমাকে দেখে জেনারেল ওসমানী বললেন, এই তুমি তো একেবারে পিচ্ছি,তুমি কি পারবে যুদ্ধ করতে ? জবাবে আমি বললাম,স্যার,দোয়া করবেন,দেশের জন্য আমি আমার জীবনটাও দিতে পারি।
জেনারেল ওসমানী সাহেব যাওয়ার পর দিনই আমাকেসহ আমাদের ২০০ জনের একটি গ্রুপকে উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য আসামের অম্পি নগর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এখানে ২০০জনকে ২৫ জন করে ৮টি ভাগ ভাগ করে ২১ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।এই ৮টি গ্রুপের একটি গ্রুপের কমাণ্ডার ছিলাম আমি। আমরা এখানে রাইফেল,এসএমজি,এস এল আর,মেশিনগান,হ্যান্ড গ্রেনেডের প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। এরপর আমাদেরকে অম্পি নগর থেকে কোনাবন ক্যাম্পে নেওয়া হয়। পুরো যুদ্ধে আমি এসএলআর চালাই। কমান্ডার ওহাবের নেতৃত্বে আমাদের ২৫ সদস্যের দলটি যুদ্ধ করি ব্রাহ্মনবাড়িয়ার কসবা উপজেলা ও কুমিল্লার ব্রাহ্মনপাড়া ও বুড়িচং উপজেলাসহ নানা প্রান্তে যুদ্ধ করি।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
সম্ভবত: অক্টোবরে মাসের ঘটনা। আমাদের গ্রুপে ২২ জন। জনৈক আর্মি হাবিলদারের নেতৃত্বে মন্দভাগ সন্নিকটে মইনপুর গ্রামের একটি মাটির ঘরে ক্যাম্প স্থাপন করে। মজার বিষয় হলো যুদ্ধের পুরো সময়টা মন্দভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আর শালদানদী পাক বাহিনীর দখলে ছিল। মন্দভাগ দখলের জন্য পাক বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। তখনও সূর্য পুরোদমে ওঠেনি। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ করেই দেখলাম পাকবাহিনী লাইন ধরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা ভাবেনি এত ফ্রন্ট লাইনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আছে। শেষ রাতের ডিউটিতে আমি আর হান্নান ছিলাম। হান্নান আজ-আর বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর হতাশায় কাজ/চাকুরী না পাওয়ায় অবশেষে ডাকাতি করে। একসময় সে কষ্ট নিয়ে পরপারে চলে যায়। কমান্ডার ও অন্যদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। সবাই ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে যার যার অস্ত্র নিয়ে রেডী হতে থাকে। কমান্ডার নির্দেশ দেয় পজিশন মোতাবেক কমান্ডার এলএমজি ফায়ার করার সাথে সাথে সকলেই ফায়ার করবে। প্রথম ১০/১৫ জনকে কমান্ডারের টার্গেট। পরবর্তীদের ভাগ-করে দেওয়া হয়। আমি কমান্ডারের ব্যাংকারে এসএলআর নিয়ে পজিশন নেই।
পাক বাহিনী যখন ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে এসে পড়ে কমান্ডার ফায়ার ওপেন করে তখন আমি ও পরবর্তী ৪/৫ জনকে টার্গেট করে ফায়ার শুরু করি। হতচকিত পাক বাহিনীর সামনের অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয় ও মাটিতে কাতচিৎ হয়ে গোঙ্গাঁতে থাকে। এমনকি সামনে থাকা অধিনায়ক ও সিগন্যাল ম্যান মাটিতে পড়ে চেচামেঁচি করে। মৃত্যুর পূর্বে গুলি খেলে কি কষ্ট হয় তাদের কাতচিৎ ও গোঙ্গাঁনীর শব্দ-শুনে অনুভব করি। তারা অনেকটা গুছিয়ে আমাদেরকে নিশানা ঠিক করে আবার ফায়ার করতে থাকে। তখন দেখলাম জীবিত পাকবাহিনী শুয়ে ১ জন আহত, ১ জন নিহতকে পিঠে নিয়ে ক্রলিং করে পেছাতে থাকে। অমনি শুরু হয়ে যায় পাক বাহিনীর আর্টিলারির ফায়ার। আমাদের সামনে পেছনে গোলা পড়তে। থাকে। ভাগ্যিস কোন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। যুদ্ধ চলতে থাকে।
বেলা এগারটার দিকে কমান্ডার আমাকে ও হান্নানকে অর্ডার করে, “প্রায় এক-কি:মি: দূরের ক্যাম্প থেকে আমাদের খাবার আনার জন্য”। এমন গোলাগুলি-দাঁড়াবার সুযোগ নেই। তাই আমরা দুজন ক্রলিং করে খাবার আনতে খাল দিয়ে পানি ভেঙ্গে যেতে শুরু করি। মাথার উপর দিয়ে শা শা করে গুলি চলছে। ৪০০/৫০০ গজ যাওয়ার পর দেখি পাক-বাহিনীর ফাইটার বিমান মাথার উপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। দুজনে দ্রুত একটি মাটির ঘরে গিয়ে উঠলাম। দেখলাম ঘরে সকল মালামাল পড়ে আছে। ভাবলাম হঠাৎ করে গোলাগুলি শুরু হওয়ায় লোকজন অন্যত্র চলে গেছে। ঘরে একটা ট্রানজিস্টার ছিল। বললাম হান্নান এটা নিয়ে নাও। জয় বাংলা বেতারে খবর শুনা যাবে। হান্নান বললো দেখোতো ফাইটার বিমান আকাশে চক্কর দিচ্ছে। এখন যে কেউ মারা যেতে পারি। এসময় ট্রানজিস্টার নেওয়ার জন্য গুনাহগার হতে হবে। ভাবলাম হান্নানতো আমার চেয়েও সৎ। ফাইটার। বিমান চলে যাওয়ার পর ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম ‘পাক বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের’ মুখে মইনপুর থেকে আমাদের উইথড্র করা হয়েছে।
পরিচয় :
সিরাজুল ইসলাম। পিতা মরহুম নজরুল ইসলাম এবং মাতা মরহুম রাবেয়া বেগম। ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মনপাড়া উপজেলার মাদবপুর ইউনিয়নের মুকিমপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি ইসলামের ইতিহাস বিভাগ হতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে ভৈরব হাজী আসমত কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্রঐক্যে থেকে ভিপি নির্বাচিত হন। স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন তিনি। ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়া শুনা করেন। সমবায় অফিসার বাবা নজরুল ইসলামের চাকুরির কারণেই কিশোরগঞ্জে তার বেড়ে উঠা। ১৯৮৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মোসাম্মত নিলুফা আক্তারের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বর্তমানে তিন মেয়ে ও এক ছেলের গর্বিত জনক।