‘কত না কষ্ট করেছিলাম এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য ’

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -২৪
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীরমুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন এফ এফ বাহিনীর কুমিল্লা কোতয়ালী থানা কমান্ডার আবদুল মতিন বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে ৭ মার্চ ভাষণ দেন তখন এই ভাষণ শোনার জন্য আমরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দল বেঁধে কুমিল্লা থেকে ঢাকা গিয়েছি। যেহেতু ছাত্রলীগ করতাম তাই তখন শরীরও ছিল গরম। তাই মানুষের ভিড় ঠেলে একেবারে মঞ্চের সামনে গিয়ে বসেছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। তখন আমাদের শরীর এবং মনের যে কি অবস্থা হয়েছিল তা কাউকে বুঝাতে পারব না। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কুমিল্লা এসেই যুদ্ধ শুরু করে দেব।
যেই কথা সেই কাজ। ঢাকা থেকে এসে দিন দুয়েক পরে আমাদের নেতা অ্যাড.আহমেদ আলী,অধ্যাপক খোরশেদ আলম স্যার,অধ্যক্ষ আফজল খান,সৈয়দ রেজাউর রহমান ,ভিপি শাহআলম ভাইদের সাথে কথা বলে ভিক্টোরিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষের সাথে কথা বলালম। পর দিন কলেজের বিএনসিসির রাইফেলগুলো এনে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলাম। প্রশিক্ষক ছিলেন কুমিল্লার ডিফেন্সের বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা।
২৫ মার্চ কালো রাতে হানাদার বাহিনী যে আক্রমণ করবে এটা আমরা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। বর্তমানে কুমিল্লার বিএনপি নেতা হাজি ইয়াছিন সাহেবের আরকু ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এলাকায় একটি কাঠেরপুল ছিল। ২৫মার্চ সন্ধ্যায় আনসার আহমেদ (পরবর্তী পর্যায়ে কুমিল্লা সদর আসনের ২বার এমপি হন),মতিউল ইসলাম মন্টু,ভিপি শাহআলমসহ মেলিরিয়া ইরিডিগেসনের একটি জিপ গাড়ি নিয়ে নগরীর গোধীরপুকুর পাড়ের আবদুল হাকিম সাহেবের( বরুড়ার প্রয়াত এমপি) পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নিয়ে আমাদের কাছে খবর ছিল হানাদার বাহিনী এই দিক দিয়ে শহরে ঢুকবে। তখন আমরা পেট্রোল দিয়ে কাঠের পুলটি জ্বালিয়ে দেই। এটা ছিল আমাদের আনুষ্ঠানিক একটি অপারেশন। এর কিছুক্ষণ পরেই এই এলাকায় গোলাগুলির আওয়াজ পাই। ২৫ মার্চ কুমিল্লা পুলিশ লাইনে নতুন পুলিশদের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা ছিল। যার কারণে অন্য দিনের থেকে এদিন একটু সংখ্যায় বেশি ছিল পুলিশ। এজন্য রাতে হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদও হয় বেশি ।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু : ২৭মার্চ সকালে আনসার আহমেদ, নাজমুল হাসান পাখি,অধ্যক্ষ আবদুর রউফ, অ্যাড.রুস্তম আলী , ভিপি শাহআলমসহ আমরা সীমান্ত অতিক্রম করি। আমি ওই দিন সোনামুড়া খালার বাড়িতে অবস্থান করি আর অন্য নেতারা নিজেদের মতো করে থাকার ব্যবস্থা করে। কারণ,তখনো আনুষ্ঠানিক কোন খবর ভারতের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হয়নি বা কোন ক্যাম্প তখনো খুলেনি। কিছু দিনের মধ্যেই আমরা বক্সনগরের যুব শিবিরে যোগ দেই। এই যুব শিবিরের প্রধান ছিল অধ্যক্ষ আবদুর রউফ স্যার। একটি হাই স্কুলে এই শিবিরটি করা হয়। আমরা এখানে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ লোক ছিলাম। এপ্রিলের শেষের দিকে আমাদের থেকে ৫০ থেকে ৬০ জনকে বেছে ওম্পিনগর নিয়ে যায় ভারতীয় সেনাবাহিন্ ী। এই ক্যাম্পটি সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর আব্রাহাম। এখানে এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টাস মেলাঘরে। তখন এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশারফ। তিনি আমাদের সবার মাঝে অস্ত্র সরবরাহ করেন। আমাকে দেওয়া হয় একটি স্টেনগান। একই দিন আমাকে এফ এফ বাহিনীর কুমিল্লা কোতয়ালী থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার নিযুক্ত করে। এ সময় খালেদ মোশারফ ছাড়াও মেজর হায়দার,বিএম মতিনসহ আন্যানরা উপস্থিত ছিলেন। পরে আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবের নিকট প্রেরণ করলে আমরা নির্ভয়পুর চলে যাই। এ সময় আমার সাথে ছিলেন আবু,আসাদ ও নাজিমসহ ১৫জন।

যুদ্ধের অনুপম গল্প : ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতেৃত্বে প্রথম যুদ্ধ করি মিয়াবাজার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। এই সড়ক দিয়ে হানাদার বাহিনী প্রতিদিন অসংখ্যবার যাতায়াত করত। তাই আমরা রাস্তার ওপর অ্যামবুশ করলে হানাদার বাহিনীর প্রথম কয়েকটি গাড়ি অ্যামবুশে পড়ে ব্যাপক হতাহত হয়। তখন তাদের পেছনের গাড়িগুলো পাল্টা আক্রমণ করলে অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা পেছনে ফিরে আসি। এর পর ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা আরো কয়েকটা যুদ্ধ করি এক সাথে। পড়ে আমাদের মতি নগর ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে কোতয়ালী থানায় পাঠানো হয়। ১৫/২০ জন যুবক নিয়ে আমি মতিনগর আসি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদের সাথে আরো ১০/১৫জন যুবক যোগ হয়। কোতয়ালী থানা কমান্ডার হিসেবে আমার নেতৃত্বাধীন এলাকাগুলো হলো, বিবির বাজার থেকে গোমতী নদী পাড়,মতিনগর সীমান্ত এলাকা,আমড়াতলী –পাঁচথুবি,কালির বাজার এলাকা এবং বারপাড়া,চৌয়ারা ও পিপুলিয়াসহ আশেপাশের এলাকা ।
এক কথায় অবিভক্ত কোতয়ালী থানা। আমাদের এই পুরো কমান্ডে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন যোদ্ধা ছিল। এত বড় একটি থানা চালাতে গিয়ে মাঝেমাঝে আমি হিমশিম খেয়ে যেতাম। কিন্তু কখনো ভেঙ্গে পড়িনি। এক দিকে যুদ্ধের রণকৌশল ঠিক করা, প্রতিপক্ষের অবস্থান সার্বক্ষণিক নজরে রেখে নিজেদের অবস্থা ঠিক করা,মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার,পানি,ভাতার ব্যবস্থা করা। পুরো থানা যুদ্ধের প্রয়োজনে চার-পাঁচ ভাবে বিভক্ত ছিল তা সমন্বয় করা,ভারতে গিয়ে আমাদের হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করাসহ নানা চ্যালেঞ্জ প্রতিনিয়ত আমাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে খাবারের সংকট ছিল অনেক সময় তীব্র থেকে তীব্রতর। কারণ, সরকারিভাবে এফএফদের জন্য কোন রেশন ছিল না। আমাদের দায়িত্ব ছিল জনগণ থেকে রেশন নেওয়া। এটা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থার মত দেখা গেলেও যুদ্ধের মাঠে এগুলো দেখার কোন সুযোগ ছিল না। এমনও অনেক সময় গেছে,ভারতের হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে আমাকে। আমি হয়তো তখন ছিলাম বারপাড়া বা অন্য কোথায়ও। পকেটে টাকা নেই। তীব্র ক্ষুধাও লাগছে। তারাতারি পৌঁছতে না পারলে ক্যাম্প কমান্ডারকে পাওয়া যাবে না ইত্যাদি নানা সমস্যা ছিল্ । অনেক সময় হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে কিন্তু দাঁড়াবার কোন সুযোগ ছিল না। কত কষ্ট যে করেছি তার কোন হিসেব নেই। এখন ওই কষ্টের কথাগুলো ভাবলে চোখে পানি চলে আসে। কত না কষ্ট করেছিলাম এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য।

একটি যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে বললে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে পারে। আমড়াতলী-ইটাল্লা-বসন্তপুর নামক যুদ্ধটি ছিল খুবই ভয়াবহ। হঠাৎ কোতয়ালী থানা কমান্ডিং এলাকায় একটি মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল চার কোম্পানির ওপর। আমরা প্রথম তাদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা করতে পারিনি। তারা তিন দিক দিয়ে আমাদের এ্যাটাক করে ফেলে। কোন উপায় না দেখে ক্যাপ্টন দিদারুল আলমকে সাহায্য করতে বললে তিনি ৩ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দেয়। চলে সমান তালে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১০/১৫জন সৈনিক নিহত হয়। তারা আমাদের ধনঞ্জয় নামক গ্রামে এক সাথে ৩৬জন নিরীহ নারী পুরুষকে মেরে একটি ঘরে আটকে রাখে। পরে আমরা খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে কোন মতে জানাযা দাফন কাফন ছাড়া গোবরের গর্তে মাটি চাপা দিয়ে রাখতে বাধ্য হই। এ ছাড়া ওই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিল না।

পরিচয় :
আবদুল মতিন। বাবা ছলিম উদ্দিন মা করফুলের নেছা।১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাতার এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। কুমিল্লা ইউছুফ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কুমিল্লা আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ আফজল খান যখন ১৯৬৬ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিপি তখন তিনি এই কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়ান। তিনি কুমিল্লা জেলা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেরও সক্রিয় সদস্য ছিলেন এ সময় আহ্বায়ক ছিলেন ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ভিপি শাহআলম।