গোটা ভারত জান,মাল দিয়ে আমাদের সহায়তা করলেও তাদের মিজোরো ছিল বিপক্ষে- ফয়েজ আহমেদ

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্পা - ২২
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকেই চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা এলাকার রেয়ন মিলে কর্মরত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন শুনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
হঠাৎ ২৫ মার্চ সকালে আমাদের প্রশিক্ষক বললেন, আজ তোমাদের উদ্দেশ্যে একজন মেজর সাহেব বক্তব্য রাখবেন। মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আমরা যথারিতি অপেক্ষায় আছি. মেজর সাহেবের আসার । তিনি সম্ভবত বেলা ১১টার দিকে আমাদের স্কুল মাঠে আসলেন। এসে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে শুধু এতটুকু বললেন যে, আমি মেজর জিয়া এদেশেরই সন্তান (তিনি ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ও পরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন)। পরের লাইন বললেন, যুদ্ধ আমাদের শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে যুদ্ধ করার জন্য আমি মাত্র ৫০ জন চাই। প্রথম যে ৫০জন হাত উঠাবে আজ আমি তাদেরই নিব। আমরা ৫০ জন হাত উঠালে তিনি আমাদেরকে নিয়ে চন্দ্রঘোনা থানার সামনে নিয়ে যান। ঐ খানে আমাদের কিছুটা রেষ্টের সময় দিয়ে ৫০জনকে ৫০টা রাইফেল দিয়ে বললেন,তোমরা এখনি কালুরঘাট চলে যাবা। ক্যাপ্টেন আবদুল করিমকে আমাদের কমান্ডার করে পাঠালেন। কালুরঘাটে গিয়ে আমরা বাংকার করলেও সোর্সের বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে হানাদার বাহিনী আমাদের বাংকারের শক্তিমত্তা জেনে যায়। ফলে তারা বাংকারে আক্রমন করতে আসার আগেই আমরা চলে আসি। আর অল্পের জন্য ঐ দিন আমাদের প্রান বেঁচে গেলেও আমাদের এলাকার বাতিসার সোনাপুর গ্রামের আবদুল করিমের ছেলে চাঁন মিয়া শহিদ হন। আমরা সবাই বাংকার থেকে চলে এলেও সে না এসে বলল,তোমরা যাও আমি আসছি। কিন্তু এর কিছুক্ষন পরেই হানাদাররা এসে বাংকারে আক্রমন করলে সে একাই ফায়ার শুরু করে। পরে তাদের পাল্টা ফায়ারে সে শহিদ হয়।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
আমরা ১৮ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটির চন্দ্রগোনার এপিএম স্কুল মাঠে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ যুবক স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে প্রশিক্ষন নেই। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা। এখানে আমরা প্রায় ৭/৮দিন প্রশিক্ষন নেই। এরপর যুদ্ধ শুরু করি। পরবর্তী সময়ে ভারতের দেমাকগিরিতে ১৫ দিন এবং লোহাবনে আরো ১৫ দিন প্রশিক্ষন নেই।এ সময় আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :

প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ আহমেদ বলেন, মার্চের ২৯ তারিখে ক্যাপ্টেন আবদুল করিমের নেতৃত্বে বাংকার ছেড়ে আমরা চট্টগ্রামের মদিনা ঘাট আসি। এসে দেখি এখানে বিভিন্ন বাহিনীর অসংখ্য সদস্য রয়েছে।এখানে এসে আমরা এ্যামবুশ করি। আমাদেরকে সকালের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হলো। আমরা সবাই ছিলাম সারা দিনের অভুক্ত। ক্ষুধার জ্বালা যে কি জিনিস, সেদিন হারে হারে টের পেলাম। বিকাল ৫টা হবে। এমন সময় ক্যাপ্টেন করিম বলল, দ্রুত চল।ওরা এ দিকে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তখন আমরা নোয়াপাড়ার দিকে যাই। নোয়াপাড়া লংগর খানায় এসে খাবারের মুখ দেখি। তাও আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কারণ এখানে অসংখ্য যুদ্ধা উপস্থিত। আমরাই ছিলাম ১২০ জনের একটি গ্রুপ।ভাত খেয়ে আমি ক্যাপ্টেনকে বললাম, স্যার,আমি বাড়ি যেতে চাই। আমি আর পারছি না । তখন তিনি খুব জোড়ে গালে একটি থাপ্পর দিয়ে বললেন, এই অস্ত্র ছেড়ে কোথায়ও যাবা না, নিরস্ত্র হবা না। দেশ স্বাধীন করে আমরা এক সাথে যার যার বাড়ি যাব। নোয়াপাড়া এসে এক স্কুলে রাত কাটাই।সকালে উঠে নদী পাড় হওয়ার জন্য কোন নৌকা পাচ্ছিলাম না। এমন সময় দেখি একটি নৌকা যায়। মাঝি প্রথম নিতে চাচ্ছিল না। পরে গুলি করার কথা বললে আমাদের সবাইকে পাড় করে দেয়। আমরা বোয়ালখালি থানার চৌধুরী হাট যাই। রাতে পটিয়ার একটি স্কুলে থাকি। এপ্রিলের ২ তারিখ ভোরে খবর আসে তোমরা এখান থেকে চলে যাও , ওরা তোমাদের উপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটাবে। আল্লাহর রহমতে আমরা নিরাপদ দূরুত্বে যাওয়ার পর একটি বিমান এসে ঐ স্কুল ও কলেজের উপর বোম নিক্ষেপ করে। এখানেও অল্পের জন্য আমরা রক্ষা পাই। এখানে আমাদের ক্যাপ্টেন ছাড়াও সাথে ছিলেন সুবেদার হাফিজুর রহমান ও মেজর টিওমালি।
এপ্রিল মাসের ৮ তারিখে আমরা রাঙ্গামাটির বিলাইসার নামক স্থানে আসি। বিলাইসারের জঙ্গল দিয়ে ২জন বিহারী আর ১জন পাঞ্জাবি যখন যাচ্ছিল তখন আমি,মকবুল,হাবিলদার কবির আহমেদসহ আমরা এই তিনজনকে গুলি করে মেরে ফেলি। এখানে প্রতিটি রাস্তায় রাস্তায় স্থানীয় নারী পুরুষ আমাদের সহযোগিতা করে। এপ্রিলের ১২ তারিখে আমরা ৮জন ভারতের পাংচরিতে যাই। যাওয়ার আগে ভারতের মিজোরা আমাদের ক্যাম্পে আক্রমন করে। তাদের আক্রমনে ভয় পেয়ে ভারতের সকল সৈন্য চলে যায়। পরে ক্যাম্প ছাড়ার আগ পর্যন্ত আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের ৩জনকে মেরে ফেলি। মিজোরা কি কারণে যে পাকিস্তানীদের সমর্থন করতো তা এখন ভুলে গেছি।

মে মাসে আমরা রাঙ্গুনিয়া থানা আক্রমন করি মেজর টিউমালির নেতৃত্বে। একজন অবাঙ্গালী পুলিশকে হত্যা করে থানার সব অস্ত্র আমরা লুট করে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে পোমারা নামক স্থানে আমরা ৭টি বিদ্যুতের টাওয়ার ধ্বংস করি। আমরা আবারো ভারতের মিজোদের আক্রমনের শিকার হই। ভারতের রাজস্বতলী নামক স্থানে মিজোরা এক রাতে অতর্কিত হামলা করে আমাদের কমান্ডার টিওমালিসহ ৩জন সিপাহীকে হত্যা করে। কমান্ডার টিওমালি নিহত হওয়ার পর আমরা নতুন কমান্ডার পাই নুরে আলম সাহেবকে। যিনি পরবর্তী পর্যায়ে দেশের আইজিপি হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে রাঙ্গামাটির রানীর হাটে হানাদার বাহিনীর সাথে আমাদের একটি বড় মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এটা ছিল নুরে আলম স্যারের নেতৃত্বে আমাদের প্রথম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমার বাম পা গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি খেয়ে আমি একটি ধান ক্ষেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। যুদ্ধ কিছুটা থেমে গেলে সবাই আমাকে খোঁজে ধান ক্ষেত থেকে উদ্ধার করে। পরে স্থানীয় ইদ্রিস ডাক্তারকে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। আমাকে চিকিৎসা করে যাওয়ার পথে হানাদার বাহিনী ইদ্রিস ডাক্তারকে গুলি করে হত্যা করে। পরে আমাকে মেশন হাসপাতালে ডাক্তার ইসহাক আলীর কাছে নেওয়া হয়। পরে শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার কারণে ডা.ইসহাক আলীকেও হানাদাররা মেরে ফেলে। এরপর আমাকে ভারতের আগরতলা হাসপাতাল ও পড়ে উদয়পুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই উদয়পুর হাসপাতালে আমাকে ২৫/২৬দিন চিকিৎসা করা হয়। পা কিছুটা সুস্থ হলে আবার আমি যুদ্ধে নেমে পড়ি। তবে আগের মত মাঠের সরাসরি যুদ্ধে না। বিভিন্ন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করি। কারণ, এই পা দিয়ে তো আর সম্মুখ যুদ্ধ করা যাবে না। ১৬ ডিসেম্বর আমরা রাঙ্গুনিয়া থানা দখল করি নুরে আলম স্যারের নেতৃত্বে।

পরিচয় :
মো. ফয়েজ আহমেদ। পিতা আবদুল মজিদ এবং মাতা ফয়জুন নেছা। ১৯৪৮ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান ৩য়।