থ্যালাসেমিয়া মুক্ত সমাজ দরকার

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত রোগ এবং বিশ^ব্যাপী সবচেয়ে বিস্তৃত রোগগুলোর মধ্যে একটি। বিভিন্ন ধরনের থ্যালাসেমিয়া আছে। তবে আমাদের দেশে হিমোগ্লোবিন-ই (Hb-E) এবং বিটা হিমোগ্লোবিন (Hb-Beta) থ্যালাসেমিয়া সবচেয়ে বেশি। ডব্লিড-এইচও এর ২০০৮ এর এক রিপোর্টে দেখা যায় বাংলাদেশে ৭% থ্যালাসেমিয়ার বাহক (Hb-E ৪% এবং Hb-Beta ৩%)। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ১৭ কোটি জনতার প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ থ্যালাসেমিয়ার বাহক (১০-১২%) এর মধ্যে হিমোগ্লোবিন ই বিটা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজরের রোগীর সংখ্যা ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার। থ্যালাসেমিয়ার উচ্চ প্রবণতার কারণ হিসাবে ধারণা করা হয় ঃ- ক) থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা খ) পরিবারিক বিয়ের প্রবণতা গ) দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে।
থ্যালাসেমিয়া বাহকরা রোগী না, তাদের কোন উপসর্গ থাকে না, তাই তাদের কোন চিকিৎসা বা খাদ্য তালিকায় সীমাবদ্ধতার প্রয়োজন নাই। তবে তাদের গুরুত্ব অন্য বাহককে বিয়ে না করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের উপর নির্ভর করে। কারণ দম্পতি দুজনেই যখন বাহক হয় তখন থ্যালাসেমিক শিশুর জন্মের সম্ভাবনা ২৫%। হিমোগ্লোবিনকে লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত রাখতে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করতে হয়। অনেক থ্যালাসেমিয়া রোগী (ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর) ৬ মাস বয়স থেকে সারা জীবনের জন্য রক্ত পরিসঞ্চালনে নির্ভরশীল হয়ে থাকে এবং শরীরের অতিরিক্ত আয়রন কমানোর জন্য নিয়মিত চিলেশন করতে হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে করা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা নাই। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন (হেমপয়েটিক ষ্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন) একমাত্র নিরাময়মূলক চিকিৎসা, বিশেষ করে অল্প বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে প্রায় ৮০% ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।
থ্যালাসেমিয়া হচ্ছে দূরারোগ্য বংশগত রক্তস্বল্পতার রোগ। এ রোগ নিরাময়ের জন্য এখনো কোন ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। বাংলাদেশে এ রোগের জিন বাহকের সংখ্যা প্রায় ১.৫ কোটি এবং এ রোগের জিন বাহকে বাহকে বিয়ে হলেই তাদের সন্তান এ রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। তাই বাহক গণসচেতনার মাধ্যমেই বাহক বাহকে বিয়ে বন্ধ করে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর জন্য সমাজের সব সচেতন নাগরিক, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সকল স্তরের জনগণের এ রোগ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে এগিয়ে আসা দরকার। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে কার্যকর ডায়াগনষ্টিক ও স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। থ্যালাসেমিয়া অভিশাপ থেকে জাতিকে বাঁচাতে ঃ- ক) বাহক শনাক্তকরণ খ) বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা গ) থ্যালাসেমিক প্রি-নেটাল টেস্ট (গর্ভের ১০-১২ সপ্তাহের মধ্যে) এবং ঘ) সচেতনতা ও কাউন্সেলিং করে সত্যিকার অর্থে কমিউনিটি শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা জরুরী।
প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার নতুন শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। দেশের শতকরা প্রায় ৭-১০ ভাগ জনগণ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। সচেতনতার অভাবে বাহকে বাহকে বিয়ে হচ্ছে। এ রোগীর সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া মেজরের প্রচলিত চিকিৎসায় প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা থাকলেও আয়রন চিলেশনের ব্যবস্থা নেই। উপজেলা পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা অত্যন্ত সীমিত। প্রতিমাসে একজন থ্যালাসেমিয়া মেজরের রোগীর কমপক্ষে পাঁচ হাজার বা তার অধিক টাকার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আয়রন চিলেশন একটি দামি চিকিৎসা এবং নিয়মিত আয়রন চিলেশনের অভাবে লিভার ও হৃৎপিন্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন হরমোনের ঘাটতিজনিত জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাই কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন ও আয়রন চিলেশনের সুবন্দোবস্ত থাকা প্রয়োজন।
থ্যালাসেমিয়া নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। জাতীয়ভাবে অতি দ্রুততার সাথে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারী হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। প্রতিরোধের প্রধান অবলম্বন হচ্ছে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম। প্রাথমিকভাবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপের জন্য (১৮ থেকে ৩০ বৎসর বয়সী) স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন। যা আমাদের বাহক নির্ণয়ে অবদান রাখবে। এ ব্যাপারে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) বিভাগে শক্তিশালী কর্মসূচীর মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া মুক্ত সমাজ গড়া সহজসাধ্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়া নিবেদিত কোন পরিপূর্ণ (নিরাময় + প্রতিরোধ) হাসপাতাল নাই। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ থ্যালাসেমিয়া নিবেদিত একটি হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ নেয়া অতীব প্রয়োজন যেখানে আধুনিক চিকিৎসার সকল সুব্যবস্থা থাকবে।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ