যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মমিন বলেছেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি ও কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আলহাজ¦ মোহাম্মদ ওমর ফারুক ভাইয়ের অনুপ্রেরনায় আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্ধুদ্ধ হই। ফারুক ভাই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি। আমরা ছিলাম কর্মী। ফারুক ভাইয়ের প্রেরণায় এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া যাই। সোনামুড়া থেকে আমাদের পাাঠিয়ে দেওয়া হলো আসামের তেজপুর ক্যাম্পে।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের আসাম রাজ্যের তেজপুর ক্যাম্পে আমরা প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের সাথে প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন ২০০ জন। এর মধ্যে নাসিরুল ইসলাম,আওলাদ হোসেন,মফিজ উদ্দিন, ফুল মিয়া ,ওয়ালি হোসেন,রেহান উদ্দিন,আবদুস সামাদ, আবদুস জব্বর ও ওসমান গনিরা ছিলেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর চৌকশ সদস্যরা আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়। এ সময় আমাদের দেশের প্রশিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন তৌহিদুর রহমান শিকদার, এড. গোলাম ফারুক,ইঞ্জিনিয়ার কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান। তারা প্রশিক্ষনে ভারতীয় বাহিনীকে সহায়তা করতো। এখানে আমরা ৩০ দিন প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের স্টেনগান,হ্যান্ড গ্রেনেট, থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোসহ ইত্যাদির উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আসামের এই তেজপুর থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ত্রিপুরার বাইকোরা ট্রানজিট ক্যাম্পে। এই বাইকোরা ক্যাম্পে আমাদের গ্রুপ ভিত্তিক ভাগ করে দেওয়া হয় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রও দেওয়া হয়। তবে অস্ত্র ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, হানাদার বাহিনী থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। আমাকে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দেওয়া হয়। আমাদের গ্রুপে ছিল ৪৫ জন। আর গ্রুপ লিডার ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান । এছাড়াও আমাদের আরো দুটি গ্রুপ ছিল। এর মধ্যে একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফিস ওসমান । এই গ্রুপটি চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারায় ঐতিহাসিক যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে। এখানে আমাদের ৯জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তারা সবাই ছিলেন ন্যাপ- সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সদস্য। আরেক গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ন্যাপের জাকির হোসেন ভাই।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
যুদ্ধের অনুপম গল্প বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল মমিন বলেন, কুমিল্লা শহর, বুড়িচং,ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বারসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করি। এর মধ্যে একটি যুদ্ধের কথা মনে হলে এখনো শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। এটি সম্ভবত অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে হবে। আমরা আমাদের কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান ও সহকারি কমান্ডার এডভোকেট গোলাম ফারুকের নেতৃত্বে ত্রিপুরার বাইকরা ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে কোনাবন বর্ডার হয়ে দেশে আসি। পরে ব্রাহ্মণপাড়ার আসাদনগর গ্রামে রাত্রী যাপন করি। সকালে কংশনগর দিয়ে নদী পাড় হয়ে দেবিদ্বার উপজেলার এলাহবাদ গ্রামে অবস্থান নিয়ে এ্যাম্বুুশ করি। এখানে আমাদের সাথে যোগ দেয় এফ এফ যোদ্ধারা। সব মিলিয়ে আমরা এখানে ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেই। উদ্দেশ্যে পাশর্^বর্তী বারুর গ্রামে অবস্থান নেওয়া হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ করা। আমরা সারা দিন ওৎ পেতে ছিলাম। কিন্তু সুবিধা করতে পারছিলাম না। হানাদার বাহিনী আমাদের এলাহবাদ গ্রামে অবস্থান জানলেও আমরা যে শতাধিক যোদ্ধা তা তারা বুঝতে পারেনি। বিকাল সম্ভবত সাড়ে চারটা কি পাঁচটা হবে। কমান্ডার মোস্তাফিজ ভাই বললেন, শুট । এক সাথে এফ এফ এবং আমরা অতর্কিত ভাবে তাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি করতে শুরু করলাম। আমাদের অবস্থান নেওয়া এলাহবাদ গ্রাম ও হানাদার বাহিনীর অবস্থান নেওয়া বারুর গ্রামের মানুষও ঐ দিন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছিল। আমাদের তীব্র আক্রমনের মুখে এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী পিছু হটে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে চলে যায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৪/৫জন সৈনিক নিহত হয় । এই যুদ্ধে আমার ডানের কাছ দিয়ে একটি গুলি যায়। অল্পের জন্য গায়ে লাগেনি। এখন মনে হচ্ছে সেদিন আল্লাহ নিজের হাতে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
পরিচয় :
আবদুল মমিন। পিতা মৃত তালেব আলী,মাতা ছিদ্দিকা খাতুন। ১৯৫৫ সালের ১১ জুলাই কুমিল্লা শহরের দ্বিতীয় মুরাদপুরে জন্মগ্রহন করেন। পিতা মাতার ২ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ঠ। কুমিল্লা কাটাবিল রফিক উদ্দিন মেমোরিয়েল হাই স্কুল থেকে তিনি এস এস সি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে শুরু করেন ছাত্র রাজনীতি। ১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর খোরশিদা আক্তারের সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি বর্তমানে তিন ছেলের গর্বিত জনক।
আগামীকাল পড়ুন ইপিআর সৈনিক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রবিউল হকের অণুগল্প