কুমিল্লা নগরীসহ আশেপাশের আবাসিক এলাকায় লাইসেন্সবিহীন ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে গড়ে উঠছে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। একদিকে পরিবেশ দূষণ, অন্যদিকে মানহীন পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে বিতরণে ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নকল বিএসটিআই মনোগ্রাম প্যাকেটের গায়ে লাগিয়েই বিপণন করছে সেসব অবৈধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিএসটিআই সনদ ছাড়াও, সেগুলোর নেই কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র ও অগ্নিনিভার্পক সনদও।
অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা নগরীর হাউজিং স্টেট এলাকায় ‘নূর ট্রেডার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) অনুমোদন ছাড়াই ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির কোনো বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, নগরীর ১ নং হাউজিং স্টেট আবাসিক এলাকায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের কার্যালয়ের সামনের একটি আবাসিক ভবনের নিচ তলায় নূর ট্রেডার্সের শ্রমিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সরিষার তেল, চা-পাতা, মসলা ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করছেন। কারখানার ভেতরে মাছি, ধুলাবালি ও অপরিচ্ছন্নতার ছাপ স্পষ্ট। উৎপাদিত পণ্যের মোড়কে বিএসটিআই সনদ বা মনোগ্রাম থাকলেও সেগুলোও নকল। প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষও কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ কারখানায় উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজার ও আশপাশের জেলায় সরবরাহ করা হয়।
এ সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নূর ট্রেডার্সের পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা পরীক্ষামূলকভাবে পরিচিতজনদেরকে দিচ্ছি আমাদের পণ্যের প্রচারের জন্য। বাজারজাত করছি না। বিএসটিআই সনদ ও পরিবেশ সনদের জন্য আবেদন করে রেখেছি। এখনো লাইসেন্স পাই নি।
এদিকে, বাংলাদেশের খাদ্য আইন অনুসারে, ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য বিএসটিআই অনুমোদন বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি নগর পরিকল্পনা আইন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন বেআইনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুমোদনবিহীন কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসটিআই সনদ ছাড়া তেলে অ্যাফলাটক্সিনের মতো কার্সিনোজেনিক উপাদান থাকতে পারে, যা লিভার ও কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, কারখানার কারণে এলাকায় দূষণের মাত্রা বেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা রুমানা আক্তার বলেন, “কারখানার দুর্গন্ধ স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। শিশুরা শ্বাসকষ্টে ভুগছে, কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।” স্থানীয় দোকানিরাও স্বীকার করেন যে, নূর ট্রেডার্সের পণ্য তুলনামূলক সস্তা হলেও গুণগত মান নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, অবৈধ কারখানাগুলো শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়, বরং নগর ব্যবস্থাপনার জন্যও মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। তারা দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও কঠোর তদারকির আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম রোধ করা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, কুমিল্লা জেলা বিএসটিআই উপ-পরিচালক কে এম হানিফ বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট সংকট রয়েছে। তাই ধাপে ধাপে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি প্রতিদিনই। নূর ট্রেডার্স এর অভিযোগটি আপনাদের মাধ্যমে পেয়েছি৷ আমরা খুব দ্রুতই সেখানে অভিযান পরিচালনা করব এবং সেটি যদি অবৈধ হয় তাহলে বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহুরা বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বিএসটিআই’কে সাথে নিয়ে আমরা খুব দ্রুতই অভিযান পরিচালনা করবো।