সরকারের পক্ষে নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে আজ বৃহস্পতিবার থেকে সব কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত কয়েক দিনের মতো গতকাল বুধবারও পোশাকশিল্প অধ্যুষিত এলাকায় বিক্ষোভ-ভাঙচুর হলে অন্তত ১৬৭ প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজধানীর উত্তরায় নিজস্ব ভবনে বৈঠকে বসেন বিজিএমইএ নেতারা। এতে সংগঠনের সাবেক ছয় সভাপতি, সেনাবাহিনী, পুলিশ, শিল্প পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি অংশ নেন। বৈঠকে যৌথ বাহিনী বিশৃঙ্খলা রোধে কঠোর অবস্থানের আশ্বাস দিলে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসায়ী নেতারা।
পরে সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী থেকে আমাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বিশৃঙ্খলাকারীদের গ্রেপ্তার করবে তারা। পোশাক মালিকরা আশ্বস্ত হওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে একযোগে সব কারখানা খোলা রাখা হবে।
এতদিন শিল্প এলাকায় সেনাবাহিনী টহল দিয়েছে। যৌথ বাহিনী হলেও ছিল না গ্রেপ্তারের ক্ষমতা।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, উপস্থিত ব্যবসায়ী নেতারা মতামত দেন, এতদিন যৌথ বাহিনী আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা বেড়েছে। বিশৃঙ্খলা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হয়। ব্যবসায়ী নেতারা নারীর চেয়ে পুরুষ শ্রমিক বেশি নিয়োগের দাবিকে ‘অদ্ভুত’ বলেও মন্তব্য করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘যেভাবেই হোক কারখানা নিরাপদ রাখা হবে– যৌথ বাহিনী এমন আশ্বাস দিয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশ নিজেদের মতো পরিকল্পনা করছে। শ্রমিক নেতারাও সহায়তা দেবেন। সবকিছু ইতিবাচক মনে হওয়ায় কারখানা চালু রাখা হবে।’
তিনি বলেন, ‘কারখানায় অভ্যন্তরীণ সমস্যা খুবই কম। মূল সমস্যা বহিরাগতরা। রাজনৈতিক কারণেও কিছু পরিবর্তন কিংবা বদল হতে পারে। তবে বিক্ষোভকারীরা বহিরাগত কিনা, তা চিহ্নিত করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সহায়তা চাইলে আমরা করব।’ ক্রেতাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘ক্রেতারা উদ্বিগ্ন। সময়মতো পণ্য বুঝে পেতে তারা শিল্পের নিরাপত্তা চেয়েছেন।’
সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘অস্থিতিশীলতার পেছনে রাজনৈতিক দলের ইন্ধন রয়েছে। ওষুধসহ বিভিন্ন শিল্পকেও পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা হচ্ছে। এসব শ্রমিকের কাজ নয়, বরং তারা প্রতিবাদ করছে।’ রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, শিল্প ও দেশকে বাঁচান।’
আবদুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর গোটা পুলিশ বিভাগই বিপর্যস্ত। শিল্প পুলিশ সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। এরই ফায়দা নিচ্ছে একটি মহল। কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করছেন। হঠাৎ ৫০-৬০ বহিরাগত এসে হামলা-ভাঙচুর করছে। তাদের মধ্যে কিশোর গ্যাং, টোকাইসহ নানা ধরনের মানুষ রয়েছে।’ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে না। তাহলে নিয়োগে নারী-পুরুষ বৈষম্যের প্রশ্ন কেন আসবে?’
রপ্তানি আদেশ চলে যাচ্ছে ভারত-পাকিস্তানে
সংবাদ সম্মেলনের আগে বৈঠকে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, ‘কারখানা খোলা কিংবা বন্ধ রাখার বিষয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হতে হবে। মজুরি পরিশোধ নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে বিজিএমইএ আর্থিক সহায়তা দিতে পারে।’ বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, শিল্পের চলমান সংকট কাটাতে সব উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের বসা উচিত। বহিরাগত কারা, কেন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তারা এমন ভূমিকায় এলো– খতিয়ে দেখতে হবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রপ্তানি আদেশ ভারত ও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সাবেক সভাপতি কুতুব উদ্দিন বলেন, সমস্যা সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করা গেলে তিনি হয়তো সমাধান দিতে পারবেন। বৈঠকে সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা, আনার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, এস এম ফজলুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিশৃঙ্খলাকারীরা বহিরাগত: উপদেষ্টা হাসান আরিফ
স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেছেন, শিল্পাঞ্চল এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলাকারীরা শ্রমিক নন, বহিরাগত। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অফিস কক্ষে বৈঠক শেষে তিনি এ কথা বলেন। টানা কয়েক দিনের শ্রমিক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৈঠকে বসেন কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের কথা হচ্ছে, প্রকৃত শ্রমিক কখনও নিজের বাড়ি (কর্মস্থল) পোড়াবে না। কারণ, এটা তাদের জীবিকা। প্রাণ কোম্পানিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে তো শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ছিল না। এটা যদি নষ্ট হয়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আসা বন্ধ হবে। স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবকিছু চিন্তা করেই আমাদের এগোতে হচ্ছে। এসব যারা করছে, তাদের অধিকাংশই বহিরাগত। তাদের কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে জন্য হয়তো আমাদের একটু কঠোর হতে হবে, শক্ত হতে হবে।’
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘এ আন্দোলনে শ্রমিকদের দেখা যাচ্ছে না। টাকা দিয়ে যাদের এমন আন্দোলনে নিয়ে আসা হয়, সেসব টোকাইকে দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকদের কিছু দাবি আছে, যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি। যেমন– বেতন বাড়ানো, শ্রম আইন সংশোধন। এগুলো তো একদিনে করা যাবে না। তার পরও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, তারা তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।’
আসিফ বলেন, ‘আমরা বলেছি, যারা বহিরাগত, তাদের আলাদা করেন। শ্রমিকদের আলাদা করেন। যারা ছোট ব্যবসা নিয়ে সন্ত্রাস করছে, আওয়ামী লীগের লোকেরা যেসব সিন্ডিকেট চালাত, তারা সেগুলো ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা দখলের চেষ্টা করছে এবং বহিরাগত যারা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’