বরিশালে নারীদের বানানো প্রায় লাখ লাখ তালপাখা প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। তালপাখা তৈরি করে শতাধিক পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। পাশাপাশি তালপাখা তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে একাধিক গ্রামের নারীরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ তালপাখায় বিভিন্ন রংয়ের টুকরা কাপড়, সূতা ও রং ব্যবহার করে আনা হচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ভ্যপসা গরম ও প্রচণ্ড তাপদাহে বিভিন্ন মেলা ও জেলার বিভিন্ন খুচরা এবং পাইকারী দোকানগুলোয় বিক্রি করা হচ্ছে এ তালপাখা।
একটু বেশি অর্থের আশায় তৈরি করা হচ্ছে রং-বেরঙের বিভিন্ন সাইজের ঐতিহ্যবাহী এ তালপাখা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হচ্ছে চিরচেনা এ তালপাখা। তাই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন পাখা পল্লীর তালপাখা তৈরির কারিগররা।
বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী গ্রামের পাখা পল্লীর একাধিক কারিগর জানান, এ পাখা পল্লীর তালপাখা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন মেলা, হাট-বাজার, বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা দোকানে।
গরম এলেই প্রচণ্ড তাপদাহ থেকে একটু আরাম পেতে সবার হাতেই দেখা যায় তাল পাতার হাত পাখা। আর এসব পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শতাধিক পরিবার।
এ বিষয়ে পাখা পল্লীর নারী কারিগর শেফালী, সুমা ও আশা জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তাদের পরিবারের সদস্যরা তাল পাতা দিয়ে হাত পাখা তৈরি করে আসছেন। গৌরনদী উপজেলায় গ্রামটির নাম ‘চাঁদশী’ হলেও পাখা তৈরির এলাকাটি ‘পাখা পল্লী’ নামেই সবার কাছে পরিচিত।
সংসারের কাজের পাশাপাশি তালপাতা দিয়ে হাত পাখা তৈরিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে গ্রামটির অনেক নারী। গরমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মচাঞ্চল্যও বাড়ে ‘পাখা পল্লী’-এর মানুষদের।
এ সময় তালপাতা দিয়ে তাদের বানানো পাখার চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। তালপাতার পাখা বানিয়ে অনেকের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা।
এসব নারী কারিগররা আরো জানান, পাতা সংগ্রহ, ধোয়া, শুকানো এবং পরিষ্কার করার কাজটা করে পুরুষরা। বাকি কাজ নারীদের। পাখা আকৃতির মতো পাতাগুলো কেটে রং দেয়া, বাঁশের কাঠি যুক্ত করা, সুই ও সুতা দিয়ে বাঁধায়ের পর পাতাগুলো হয়ে ওঠে সুন্দর হাত পাখা। একজন নারী প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ পিস পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারেন। ৮০টি হাত পাখা সুই-সুতা দিয়ে সেলাই ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের বিনিময়ে পেয়ে থাকেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
এদিকে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার তালপাখা তৈরির কারিগর কাসেম খলিফা, আবুল হোসেন, শাহজাহান খলিফা,স্বপন খলিফাসহ একাধিক হস্তশিল্পী (কারিগর) জানান, সপ্তাহে একদিন পাইকাররা এসে বাড়ি থেকে হাত পাখা ক্রয় করে নিয়ে যায়। পাখা তৈরি করাই হচ্ছে তাদের গ্রামের প্রধান আয়ের উৎস। তাদের হাতে তৈরিকৃত হাত পাখা বিক্রি হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মেলা, হাট-বাজার, বাসষ্ট্যান্ডসহ দেশজুড়ে।
কারিগররা আরো জানান, উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির পর অর্থাভাবে এ পেশার সঙ্গে জড়িত আরো প্রায় পঞ্চাশটি পরিবার পেশা পরিবর্তন করেছেন। বাকি পরিবারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে সহজ শর্তে সুদ মুক্ত ঋণ দেয়ার জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের আশু হস্থেক্ষেপ কামনা করেছেন।
গৌরনদী উপজেলার চাদঁশী ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রামের বহু নারী সংসারের পাশাপাশি তাল পাতার পাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে এ গ্রামে পাখা তৈরি করা হচ্ছে। তেমন কোনো সরকারি সহয়তা পাননি পাখা তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হলে এ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের আরো প্রসার ঘটবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করর্পোরেশন (বিসিক) বরিশালের উপমহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. জালিস মাহমুদ বলেন, পাখা পল্লীর পাখা দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় পাখা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পোঁছে যায়। এখানকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হস্থশিল্পী ও কারিগরদের সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত বিসিক কর্তৃপক্ষ। সমস্যা সমাধানে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে আরো বড় পরিসরে কাজ চালিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে।
বরিশালের ডিসি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তালপাখার এ শিল্পকে ধরে রাখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবন মানের উন্নয়ন দরকার। চাদঁশী পাখাপল্লীর বাসিন্দাদের নিয়ে সমিতি গঠন করে তাদের মাঝে টাকা প্রদানের জন্য আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের মধ্যে নগদ অর্থ প্রদানসহ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।