যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা গ্রামের কৃতি সন্তান সফিকুর রহমানের আন্তরিক অনুপ্রেরণা এবং সার্বিক সহযোগিতার কারণে শুধু আমার নয় , আমাদের গ্রামের আরো কয়েক জনের যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন, নুরুল ইসলাম, আবদুল ছোয়াব, মুখলেছুর রহমান,নিজামুল হক, যোবায়ের আহমেদ এবং আবদুল হক। জনাব সফিকুর রহমান গ্রামে এসে আমাদের যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেন এবং যাওয়ার সময় পকেট খরচ বাবদ ১০ টাকা করে দিয়েও দেন। আমরা যুদ্ধে থাকাকালিন সময়ে তিনি আমাদের পরিবারের সার্বিক খোঁজ খবর নিয়েছেন। ভাল মন্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার মত দেশ প্রেমিক আমাদের দেশে খুব কমই দেখা যায় ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাজির আহমেদ বলেছেন, আমরা এই ৫ বন্ধু মিলে বিকালে বাড়ি থেকে বের হই। রাত ১০টায় গিয়ে সীমান্তের ওপারে ভারতের কোদালিয়া ক্যাম্পে পৌঁছাই।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
ভারতের কোদালিয়া ক্যাম্পে যাওয়ার পর রাতেই এখান থেকে আমাদের ৩০০ জনকে বাছাই করে পর দিন আমাদের প্রায় ৩১ জন কে অম্পিনগর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আমরা ছিলাম অম্পিনগর ক্যাম্পের প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা। আমাদের এই অম্পিনগর ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার, পাøাটুন কমান্ডার থেকে শুরু করে ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করা সবাই ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোক। এখানে আমাদের এক মাসের সফল প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে আমাদের মেলাঘর ২নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। এই ক্যাম্পে আমরা প্রায় ১৫/২০ দিন থাকার পর আমাদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য ক্যাপ্টেন হারুনের নেতৃত্বে একিনপুর পাঠানো হয়।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাজির আহমেদ বলেছেন, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বলা হলো যে, চৌদ্দগ্রামের চিওড়া ইউনিয়নের ছিলপাড়া এলাকার কুৃখ্যাত রাজাকার পতন কে ধরে আনার জন্য জীবিত কিংবা মৃত। আমি নুরুল ইসলাম,আবদুছ ছোয়াবসহ আমরা ৪জন যুদ্ধা বাড়ি এসে দেখি রাজাকার পতন পালিয়ে গেছে । তার পর আবার রাজাকার হাজি আবদুল করিম এবং রাজাকার মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহকে ধরে আনার জন্য অভিযান চালাই । কিন্তু তারা আমাদের আসার খবর পেয়েই পালিয়ে যায়। এরপর আমরা ভারতের রাঙ্গামুরা ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাংকারে যুদ্ধ করি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নাজির আহমেদ বলেন,আমাকে আর নুরুল ইসলাম ভুইয়াকে আর্টিলারী ও মেশিনগান চালানোর প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য আগড়তলা গান্ধিজি গ্রামে পাঠানো হয় ক্যাম্প থেকে। পরে সেখানে গিয়ে যখন ক্যাম্প কমান্ডার আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা জেনে যায়, তখন বলেন না, তোমনা সিগন্যালে প্রশিক্ষন দাও। গান্ধিজি গ্রামে ছিল বিএসএফ এর হেডকোয়ার্টার। এখানে ১০৫ দিন সিগন্যাল প্রশিক্ষন দেওয়ার পর আমাদের আবার মেলাঘরে পাঠানো হয়। এরপর আমাকে দশম বেঙ্গলে নিয়োগ দেওয়া হয় ভারতের বড়কাসারী ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পে আসার ১৫/২০ দিন পর আমাদের ক্যাম্প কমান্ডার এক সন্ধ্যায় বললেন, তোমাদের সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ফেনীর মন্সির হাট এলাকায় যেতে হবে। পরদিন সকালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ১০ম বেঙ্গলের আমরা যোদ্ধারা মুন্সির হাটে চলে আসি। সম্ভবত তখন অক্টোবর মাস হবে। ফেনী এবং মুন্সীর হাটের মধ্য খানে অবস্থিত বান্ধুয়া নামক স্থানে পাকিস্তানী বাহিনী ১২টি বাংকার স্থাপন করে ।
ভারতীয় সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠছে হানাদারদের এই বাংকার ধ্বংস করার জন্য। তারা কয়েক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে এই বাংকার আক্রমন করার জন্য এগিয়ে আসে। এরই মধ্যে আমাদের দশম বেঙ্গলের কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে পেছন থেকে সহযোগিতা করার জন্য বলা হয়। এতে চরম অপমানবোধ করেন তিনি। জাফর ইমাম স্যার এই অভিযানে তাদের সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভারতীয় বাহিনী নিজেরাই যুদ্ধ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খায় ভারতীয় বাহিনী। অসংখ্য হতাহত হয় ভারতীয় সৈন্য। আমি নিজে দেখেছি ভারতীয় সৈন্যরা কিভাবে গাড়িতে করে তাদের নিহত সৈন্যদের লাশ নিয়ে যাচ্ছিল। সারা রাস্তা তখন রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। পরাজিত হয়ে ভারতীয় কমান্ডার আমাদের জাফর ইমাম স্যারের কাছে পরামর্শ চাইলেন কিভাবে এই বাংকার ধ্বংস করা যায়। তখন জাফর স্যার বললেন, আপনাদের অস্ত্র গুলো আমাদের দিয়ে দেন। ইনশাল্লাহ আপনাদের কোন সহযোগিতা ছাড়াই এই ১২ বাংকার আমরা ঘুিরয়ে দেব। প্রচন্ড এক আত্মবিশ্বাসের সাথে সেদিন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম এ কথা বলেছিলেন।
আমাদের ১০ম বেঙ্গলের ৬২০ জন সদস্য ছিল। সবাইকে নিয়ে তিনি রাতে বৈঠকে বসলেন। তিনি বললেন, এই যুদ্ধে আমার মাত্র ৫০ জন সৈনিক লাগবে যারা নিশ্চিত শহিদ হচ্ছে জেনে এ যুদ্ধে অংশে নেবে। এমন ৫০ জন হাত উঠাতে পার। কে আছ এই বীর ৫০ সৈনিক। তিনি এমন ভাবে কথাগুলো বললেন, যেন মনে হলো গোটা পৃথিবীটাকে এক নিমিশে ধ্বংস করার শক্তি আমার গায়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তখন আমি সবার আগে হাত উঠালাম। এভাবে আমরা ৫০ জন হাত উঠালে তিনি এই যুদ্ধের জন্য আমাদের নিয়ে টিম গঠন করলেন। হানাদার বাহিনীর বাংকার গুরাতে হলে একমাত্র পথ হচ্ছে নদী পথ। কারণ, এ ছাড়া সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া তাদের হারানো আর কোন পথ ছিল না। কিন্তু তাদের যেই শক্তি তাতে সম্মুখ যুদ্ধ করা সম্ভব না। তাই জাফর ইমাম স্যার চমৎকার কৌশল গ্রহন করলেন। আমরা ৫০ জন রাতে পানিতে ডুবে ডুবে তাদের বাংকারের দিকে এমন ভাবে অগ্রসর হচ্ছি যাতে তারা ঘুনাক্ষরেও কোন আওয়াজ না পায়। আর আমাদের বাকীরা ছিল কভারিংয়ে। জাফর ইমাম স্যার একটি কথা খুব জোড় দিয়ে বললেন, তোমরা তাদের ১২টি বাংকার ধ্বংস করার দরকার নেই। তোমরা যদি একটি ধ্ব্ংস করতে পার তাহলে এই পাঞ্জাবীরা দেখবা সব ছেড়ে পালিয়ে যাবে। বাস্তবে হলেও তাই। এক পর্যায়ে আমরা যখন তাদের প্রথম বাংকারে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারলাম মুহুর্তের মধ্যে বাংকারটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তখন অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনী সব কিছু ছেড়ে হাতে যা আছে তা নিয়েই দিল পেছনের দিক দিয়ে দোঁড়। আর এই সুযোগে স্থল পথে আমাদের কভারিংয়ে থাকা সবাই দ্রুত এগিয়ে এল। যখন পানিতে নামি তখন ভাবিনি যে আর উঠতে পারব। নিশ্চিত শহিদ হচ্ছি জেনেই সেদিন দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এই যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় আরো যারা ছিলেন তারা হলেন, ক্যপ্টেন হারুন অর রশিদ, ক্যপ্টেন ইমামুজ্জামান, ক্যপ্টেন খালেকসহ অন্যান্যরা।
আরেকটি যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নাজির আহমেদ বলেন, নভেম্বর মাসের শেষ দিকে মেজর জিয়া (পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) আমাদের ১০ম বেঙ্গলের কমান্ডারের কাছে বললেন, চট্রগ্রাম সেনানিবাস আক্রমন করার জন্য তোমরা আমাকে সাহায্য কর। তখন আমরা পুরো টিম চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। এমন সময় মিরেরশ^রাইের বাশবাড়িয়া নামক স্থানে হানাদার বাহিনী আমাদের আক্রমন করে । তখন আমরা যে পুরো কোম্পানী এক সাথে এটা তারা বুঝতে পারেনি তারা। আমরা যখন পাল্টা আক্রমন শুরু করলাম তখন তারা পিছু হটে চলে যায়। এ যুদ্ধে তাদের কয়েকজন হতাহত হয়। পরে আমরা গোল মোহাম্মদ জুট মিলের পাশ দিয়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেই।
পরিচয় :
ডা.নাজিম উদ্দিন আহমেদ। পিতা হাজি নিজাম উদ্দিন ভুইয়া। ১৯৫১ সালের ৫ জানুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের লুদিয়ারা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ৪ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। তিনি ১৯৭০ সালে বাতিসা হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন ।