যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
১৯৭১’র অন্যতম বীর সেনানী আবদুর রহীম মাহমুদ আফেন্দি বলেছেন, ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে আমি মোজাহেদ কোম্পানীর কমান্ডার ছিলাম। পরে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চেয়ারম্যান হই। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আমার মনে হতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের পূর্ববঙ্গের জন্য যে বাজেট দেয়, তা ছিল পশ্চিম বঙ্গের ইউনিয়ন গুলোর তুলনায় কম। চাকুরী জীবনেও পশ্চিমা শোষনের শিকার হয়েছি। তাই, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরই বিশ্বাস জন্মেতে শুরু করল যে ,আমরা একদিন স্বাধীন হবো। তাই মানুসিক ভাবেও সে ভাবে প্রস্তুতি ছিল। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে পাঞ্জাবিরা যে গণহত্যা চালায় তা আমি শুনেছি ২৬ মার্চ সকালে। ওরা,আমাদের দেশের নিরিহ মানুষকে মেরেছে এই জেদ আমার মনে চেপে বসেছে। তখন আমি তাৎক্ষনিক চলে এলাম পরশুরামে। এখানে এসে পরশুরাম আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলামের সাথে দেখা করি। তিনি তখন পরশুরাম থানা উন্নয়ন পরিষদের একটি সভায় ছিলেন। তাকে বললাম,ভাই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এখন আর মিটিং করে কোন লাভ হবে না। তিনি বললেন,চেয়ারম্যান বল,তুমি কি করতে চাও ? আমি বললাম,যুদ্ধে যাব। দেশ স্বাধীন করব,তরুণদের সংগঠিত করব। তিনি বললেন,তুমি যেহেতু সৈনিকও ছিলা সুতরাং তুমি যদি নিজের চেষ্টায় সংগঠিত করতে পার তাহলে অবশ্যই আমাদের সমর্থন থাকবে। এখন পর্যন্ত আমরা কোন নেতাদের নির্দেশ পাই নাই। আমিনুল ইসলাম ভাইয়ের সমর্থন থাকবে এই কথাটিই শুধু আমার দরকার ছিল। এই মুখের সমর্থন নিয়েই যাত্রা শুরু করলাম যুদ্ধের।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
পরে এদিনই (২৬ মার্চ) ছোট ভাই আবদুল হালিম মাহমুদকে সাথে নিয়ে পুরো পরশুরাম ঘুরে ৪৫ জন যুবককে সংগ্রহ করলাম। যারা আমার সাথে যুদ্ধে যেতে রাজি হয়েছে। একই দিনগত রাতে আমি ফেনীতে যোগাযোগ করে আমাদের এমপি খাজা আহমদ সাহেবের অনুমতিও নিয়ে নেই। আমি,ইসহাক,আবদুল হালিমসহ আমরা মোট ৪৫ জন এক সাথে হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম পরশুরাম স্কুলে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। আর আমি নিজেই প্রশিক্ষক হয়ে গেলাম। একটানা দুই সপ্তাহ অর্থাৎ প্রায় ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তাদের আমি অস্ত্র চালনার এবং কিছুটা গেরিলা প্রশিক্ষন দেই। প্রশিক্ষন শেষে একদিন রাতে ফেনী গিয়ে খাজা আহমদ এমপি সাহেবের সাথে করনীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন. তোমার মতামত কি ? আমি বললাম, আমি চিন্তা করেছি,পরশুরামের বিভিন্ন আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে হানাদার বাহিনী। অনেক অবাঙ্গালী আনসার -মোজাহেদ ও পুলিশ রয়েছে । যাদের ডিউটি আছে ছোট ছোট জায়গায় ২/১ জন করে। তাদের অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে এনে আমরা যুদ্ধ করব। তখন এমপি সাহেব আমার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে বললেন,আফেন্দি চেয়ারম্যান, এটা কি সম্ভব ? আমি বললাম,আপনি অনুমতি দিলে সম্ভব। যেই কথা সেই কাজ। চেয়ারম্যান এবং আনসার কমান্ডার হিসেবে এই জায়গায় আমার আগেরই চেনা ছিল। তাই আমরা পরশুরামের বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় ঘুরে ঘুরে গেরিলা নিয়মে তাদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে মারধর করে ধরে নিয়ে আসতাম। আবার কেউ যদি বাড়াবাড়ি করত তখন তাদের বন্ধুক দিয়েই হত্যা করে লাশ ফেলে বীরদর্পে চলে আসতাম। ইতিমধ্যে আমি কমান্ডার হয়ে এই ৪৫ জনকে নিয়ে একটি কমান্ড বাহিনী গঠন করি। যা ছিল পরশুরাম উপজেলায় প্রথম। তখনও এই এলাকায় মেজর জাফর ইমাম শুধু নয়, বাঙ্গালী কোন আর্মি বা কোন কমান্ডের পা ও পড়েনি। যখনই আমি অবাঙ্গালী আনসার মোজাহেদদের হত্যা করে কিংবা জখম করে অস্ত্র লুটিয়ে নিচ্ছি, তখন এই খবর পাক সরকারের কাছে পৌঁছতে সময় লাগল না। তাই এলাকার শা্িন্ত কমিটি এবং রাজাকারদের মাধ্যমে প্রস্তাব এলো,তুমি শান্তি মত চেয়ারম্যানি কর,দেশদ্রোহি কর না। তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তোমার স্ত্রীও কণ্যারাও নিরাপদ থাকবে। এই
প্রস্তাব আমি প্রত্যাখান করে বললাম,আমার কাছে দেশের চেয়ে আর কোন কিছুই বড় না। এরপর বাড়িতে অনবরত হুমকী ধমকি আসতে থাকে। উপায় না পেয়ে আমার স্ত্রী তার চার কণ্যাকে নিয়ে ভারতের বিলোনিয়া চলে যায় শরনার্থী হয়ে। আমি থেকে যাই যুদ্ধ করতে।
যুদ্ধের অণুগল্প :
যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আফেন্দি বলেন,প্রশিক্ষণ শেষে আমার কমান্ডের কাজ ছিল পরশুরামের বিভিন্ন এলাকা থেকে অবাঙ্গালী ও রাজাকারদের ধরে এনে অস্ত্র রেখে দিয়ে তাদেরকে এমপি খাজা সাহেবের কাছে সোর্পদ করা। এক পর্যায়ে আমার কমান্ডে অস্ত্র অতিরিক্ত হয়ে গেলে আমি খাজা সাহেবের মাধ্যমে ভারতের বিলোনিয়া প্রশিক্ষণ শিবিরেও অস্ত্র সরবরাহ করতাম। পরশুরামের গোটা পাকিস্তানী বাহিনী ছিল তখন চেয়ারম্যান আফেন্দি কমান্ডের আতংকে। আমরা পরশুরাম,শালঘর,মির্জানগর,ভুতুমা,বক্স মাহমুদ,ফুলগাজি,শুয়াবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন চালাতাম। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে জেনারেল মঞ্জু (পরবর্তীতে জিয়া হত্যার দায়ে ফাঁসি হয়) , মেজর এনামুল হক (কুমিল্লা শহরের বাদুরতলার এম এইচ চৌধুরীর মেয়ের জামাতা) পরশুরাম এসে আমাদের সকল অস্ত্র নিয়ে যায় এবং বলে এবার তোমার নিজস্ব কোম্পানী বন্ধ করে আমাদের সাথে যুদ্ধ কর। এবং আমাকে কালই ভারতের বিলোনিয়া ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করতে বলা হয়। এর পর আমি বিলোনিয়া যাই। এ সময় আমার সাথে ছিল ঢাকা কবি নজরুল কলেজের অধ্যাপক নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন। বিলোনিয়া যাওয়ার পরদিনই আমাকে কমান্ডার করে সুবেদার ইমাম,হাবিলদার বাদশাহসহ একটি গ্রুপ পাঠায় বিলোনিয়া আক্রমন করার জন্য। সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত একটানা এখানে যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে আমাদের রওশনসহ দুই জন শহিদ হয়।
এরপর পাঠানো হয় বিলোনিয়া ষ্টেশনে। যেখানে হানাদার বাহিনীর অবস্থান ছিল। তখন আমাকে নবম বেঙ্গলের সাথে যুক্ত করা হয়। বিলোনিয়া ষ্টেশনে হানাদার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৯জন। এই ৯ জনের মধ্যে এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৮জন নিহত এবং ১ জন পালিয়ে যায়। তখন আমি একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ব্যবহার করি। কিন্তু হানাদার বাহিনী এই রক্তক্ষয়ী পরাজয় মেনে নিতে না পেরে পাতালপুরি নামক ফেনী বিমান বন্দরে হেলিকপ্টার দিয়ে বোম ফেলিয়ে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে এমপি খাজা আহমদ আমার কাছ থেকে ফেনী যুদ্ধের পরাজয় কারণ জানতে চায়। আমি যতটুকু জানি তা বলে আবার পরশুরাম চলে যাই। ফেনী বিমানবন্দরে হামলার ঘটনায় পথ পত্রিকা সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদুর রহমানের একটি পা উড়ে যায়।
১নং সেক্টরের কথা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আফেন্দি আরো বলেন, আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীতে দেশের প্রেসিডেন্ট হন) সাথেও আমি যুদ্ধ করেছি। মেজর জিয়া আমাকে ফেনী থেকে শ্রীনগরও নিয়ে যান। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক যুদ্ধা বলতে যা বুঝায় জিয়াউর রহমান ছিলেন তাই। তিনি নিজে আমাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন আবার যুদ্ধে একটি বড় সেক্টরকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। শ্রীনগরে ভারতীয় জে এন প্রধান ক্যাপ্টেন দেবনাথ এর সাথেও যুদ্ধ করেছ্।ি
কিভাবে পা হারিয়েছেন তা জনতে চাইলে তিনি জানান, ১১ নভেম্বর আমার উপর দায়িত্ব দেওয়া হলো,বিলোনিয়া যাওয়ার অগ্রবর্তি এলাকার হানাদারদের প্রোথিত মাইন উদ্ধার করা। মাইন উদ্ধার করতে করতে অগ্রসর হওয়াকালীন হঠাৎ একটি মাইন বিস্ফোরণ হলে সাথে সাথে আমার বা পা উড়িয়ে যায় আর ডান পা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একই সাথে সারাজীবনের জন্য হয়ে গেলাম পঙ্গু। ঐ দিন আমার আর্তনাদ আর কে দেখে। পা উড়ে যাওয়ার পর আমি আমার শার্ট ও গেঞ্জি খুলে উড়ে যাওয়া পা ডেকে রাখি আর কান্না করি। তখন আমি ভারতীয় সুবেদার ইরমসিংকে বললাম, দ্রুত ওয়ালেসটা দাও। নিজেই বিলোনিয়া হাসপাতালের চিকিৎসক ডা.শংকর ও ডা.মজুমদারকে ফোন করে বলি দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য। এর পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমাকে ভারতে পাঠানো হয়। দেশ স্বাধীনের কথা শুনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে। দেশ স্বাধীনের পর আমার বড় মামা ডেইলী অবজারবারের সম্পাদক ওবায়দুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালেক উকিলের সহযোগিতায় রাশিয়া গিয়ে আমার পায়ের চিকিৎসা করানো হয় এবং একটি কিত্রিম পা সংযোজন করা হয়।
পরিচয় :
আবদুর রহীম মাহমুদ। নিজ এলাকাবাসীর কাছে আফেন্দি নামেই তিনি ব্যাপক পরিচিত। পিতা আবদুর রহমান এবং মাতা হাসিনা খাতুন। ১৯৩০ সালে ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। পিতা-মাতার ৭ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পিতা আবদুর রহমান বি.এল চিথলিয়া ইউনিয়নের একাধারে ২২ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর পরবর্তী পর্যায়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ছেলে আবদুর রহীম মাহমুদ আফেন্দি। তার চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়ই শুরু হয় দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন। যেই আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক।
মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ( তাঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন) তাকে প্রশংসা সূচক চিঠি লিখেছেন। এবং তৎকালীন ফেনীর এমপি খাজাআহমেদ তার প্যাডে বীর মুক্তিযোদ্ধা আফেন্দীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে নিজের হাতে যে চিঠি লিখেছে তা এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহীম মাহমুদ আফেন্দি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের সাবেক ভিপি আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিমের পিতা।