মামিকে বলি, মা যেন ক্ষমা করে দেন-সৈয়দ নজির

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প- ৩০
শাহাজাদা এমরান।।
প্রকাশ: ২ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ নাজির আহমেদ বলেছেন, ২৬ মার্চ রাতে হঠাৎ একটি মাইকের আওয়াজে ঘুম থেকে জেগে উঠি। মাইকে বার বার ঘোষনা করা হচেছ, দেশে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যে সকল আর্মি,ইপিআর,মুজাহিদ,পুলিশ ও আনসার সদস্যরা ছুটিতে দেশে এসেছেন কিংবা চাকুরী ছেড়ে চলে এসেছেন তারা দেশের স্বার্থে আগামীকাল সকালে আমাদের ফোর বেঙ্গলের সাথে যোগাযোগ করুন। আমি পাকিস্তানে ফোর বেঙ্গলেই ছিলাম। ২৭ মার্চ সকালে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার চিনাইল স্কুলে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফ্ফার এর নেতৃত্বে ফোর বেঙ্গলে যোগ দেই। যেহেতু মামার বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া ছিলাম ,তাই বাবা-মাকে বলার সুৃযোগ ছিল না। যখন যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য মামার ঘর থেকে বের হই তখন মামিকে বললাম, মামি, আমাদের ফোর বেঙ্গল আপনাদের এলাকায় এসেছে।আমিও যুদ্ধ করার জন্য তাদের সাথে যোগ দিচ্ছি। যদি যুদ্ধ থেকে ফিরে না আসি তাহলে মা-কে বলবেন, মা যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ নজির আহমেদ বলেছেন,যেহেতু আমি আর্মিতে ছিলাম, তাই আমার তো আর প্রশিক্ষনের দরকার পড়েনি। যুদ্ধের মাঠে কিংবা ক্যাম্পে বিভিন্ন সময় বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দিয়েছি। প্রথম যুদ্ধ করে ভারতের তেলিয়ামুড়া যাই। পরদিন আমরা মতি নগর ক্যাম্পে যাই। মতি নগর ক্যাম্পে শক্তিশালী চারটি কোম্পানী গঠন করা হয় । কোম্পানী গুলো হলো, আমিন কোম্পানী,আমার নামে নাজির কোম্পানী, আবদুল ওহাব কোম্পানী ও মনির কোম্পানী।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ নজির আহমেদ বলেছেন, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার খড়মপুরের উত্তর পাশে ছিল আমাদের বাংকার আর এরও কিছুটা উত্তরে ছিল হাবিলদার মনিরের ব্াংকার। হাবিলদার মনির ছিল একজন সুনামধন্য বক্স্রার।বিপরীত পাশে ছিল পাঞ্জাবীদের বাংকার। আমরা সময়টি নিজেদের মত করে অতিবাহিত করতেছিলাম। হঠাৎ করে হানাদার বাহিনীর ছুঁড়ে দেওয়া একটি বোম এসে পড়ে মনিরের বাংকারে। এতে সাথে সাথে হাবিলদার মনিরসহ আমাদের দুই সহযোদ্ধা শহীদ হয়। এ সময় আমরাও পাল্টা আক্রমন করি। কিছুক্ষন পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি করার পর বুঝতে পারি যে, আমাদের শক্তির চেয়ে তারা অধীক শক্তিশালী। এখনই যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ না করলে কঠিন বিপদে পড়তে হবে আমাদের। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটে সীমান্ত দিয়ে একেবারে ভারতের তেলিয়ামুড়া চলে আসি। প্রথম যুদ্ধেই দুই সাহসী সহকর্মীকে হারিয়ে আমাদের সবার মন ছিল খুবই ভারাক্রান্ত।

পরবর্তীতে আমার নেতৃত্বধীন নজির কোম্পানীকে লে. দিদারুল আলমের নেতৃত্বে চাঁদপুর পাঠানো হয়। সীমান্ত ক্রস করার মুহুর্তেই আমরা ৬২জন যোদ্ধা রাজাকার বাহিনীর কবলে পড়ে যাই। তারা মিস গাইড করে। চাঁদপুর যাওয়ার সঠিক রাস্তায় না নিয়ে সারা দিন বিভিন্ন কাঁচা পাকা রাস্তা ঘুরিয়ে রাতে আমাদের লাকসামের বড়গ্রাম নিয়ে যায়। তখন প্রায় গভীর রাত। ভোর চারটার দিকে হানাদার বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলে। তখনই বুঝতে পারি আমাদের বন্ধু সেজে যারা সারাদিন আমাদের সাথে ছিল তারা আসলে রাজাকার। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে হানাদার বাহিনী আমাদের উপর আক্রমন শুরু করে। ডু অর ডাই এই পণ করে আমরাও তীব্র পাল্টা আক্রমন করতে থাকি। এই কোম্পানীর আমরা সকলেই ছিলাম ডিফেন্সের লোক। সুতরাং এই ধরনের পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তা আমাদের জানা ছিল। আমরা একটু কৌশল করে কিছুক্ষন গোলাগুলি অফ করে দেই। যাতে তারা মনে করে আমরা পিছু হটছি। এই সুযোগে আমরা কিছুটা প্রস্তুতি নেই। দুপুর ২টার দিকে আবার আমরা পাল্টা আক্রমন শুরু করি একটানা চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত। এ সময় পাঞ্জাবীদের তীব্র আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের কিছু লোক পশ্চিম দিক থেকে ডিফেন্স ছেড়ে দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা অবশিষ্টরাও চলে আসি। এই যুদ্ধে আমাদের সদর দক্ষিন উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের কনেশতলার মোস্তফা ও ফরিদপুরের হাবিব শহীদ হয় আর আহত হয় বেশ কয়েকজন। অপর দিকে পরবর্তীতে শুনেছি পাঞ্জাবীদেরও নাকি বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। এই যুদ্ধেও আমরা খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে ভারত চলে যাই। ভারত যাওয়ার পর আমাদের চতুর্থ বেঙ্গলকে ভেঙ্গে কয়েকটি কোম্পানী করা হয়। আমি বি কোম্পানীতে যোগ দেই। এই বি কোম্পানীর মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করি। আমাদের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন দিদার। প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আবদুল খালেক,সুবেদার মেজর ইদ্রিস । সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশারফ আর সেক্টর টুআইসি ছিলেন মেজর হায়দার।

এপ্রিলের শেষ দিকের একটি যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, কুমিল্লার তেলকুপি বাজারে আমরা আক্রমন করি। এই যুদ্ধে আমাদের কমান্ডার ছিলেন, ল্যান্স নায়েক গিয়াস উদ্দিন। আমাদের কাছে তথ্য ছিল হানাদার বাহিনীর একটি গ্রুপ রসুলপুর দিয়ে তেলকুপি যাবে। আমরা তাদের গতিবিধি ফলো করে করে আগাচ্ছি। ফকির বাজারের উত্তর পাশে গাজিপুরের দক্ষিণ পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় ছিল। এখানে আমরা হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক সাথে ফায়ার ওপেন করি। আমাদের এই অতর্কিত হামলার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। ফলে তারা ফায়ার ওপেন করতে করতে আমরা চলে যাই। এখানে আমাদের গুলিতে হানাদারদের তিন জন নিহত হয় আর ৭জন গুলিবিদ্ধ হয়। এটি ছিল আমাদের একটি সফল যুদ্ধ।

বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজির আহমেদ বলেন, ভারত সীমান্তের আগড়তলা সংলগ্ন এলাকায় একটি চা দোকান ছিল। সোর্স মারফত আমাদের কাছে খবর এল হানাদার বাহিনীর একটি গ্রুপ আজ রাতে সেখানে গিয়ে চা খাবে। রাত তখন প্রায় ২টা বাজে। তারা গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। ব্রাক্ষ্মনপাড়া উপজেলার ছক্কার মার পুলের পাশে একটি বড়ই গাছ ছিল। তখন আমার হাতে একটি রাশিয়ার এমজি ছিল। আমরা এর আগেই সেখানে অবস্থান নেই। যেই তারা আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ই আমরা এক সাথে ফায়ার শুরু করি। সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না । তবে পরদিন সকালে এলাকার মানুষ থেকে শুনছি ভোরে হানাদার বাহিনীর গাড়ি এসে এখান থেকে অনেক পাঞ্জাবীদের লাশ নিয়ে যায়। তাদের রক্তে পুরো এলাকা রক্তাত্ব হয়ে যায়। তবে দু:খ জনক যে, এখানে স্থানীয় দুটি শিশুও মারা যায়। রাতে হয়তো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তারা বেরিয়েছিল। কিন্তু ফায়ার লক্ষ্যভেদ হয়ে হয়তো শিশুদের কাছে চলে যায়।

কেন্দ্রের নির্দেশে এই যুদ্ধের তিনদিন পর আমরা ফেনী হয়ে চট্রগ্রাম চলে যাই। পথে পথে আমাদের অসংখ্য ছোট ছোট যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এরমধ্যে নাজিরহাট কলেজের সামনে মুখোমুখি যুদ্ধটি ছিল ভয়াভহ। তখন আমাদের সাথে পুরো ব্যাটালিয়ন ছিল। আমাদের তীব্র আক্রমনে তারা নাজির হাট কলেজ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এবং এখানে অসংখ্য হানাদার বাহিনী মারা গিয়েছিল। আর আমাদের এক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল। পরে তাকে আমরা চৌধুরী হাটে মাটি দেই। এরপর আমরা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দিন অবস্থান করার পর খবর এলো, আমরা যেন ঢাকায় চলে যাই। লঞ্চ দিয়ে নারায়নগঞ্জ হয়ে ঢাকা যাই। এটি সম্ভবত ডিসেম্বর মাসের ৮/১০ তারিখ হবে। ঢাকায় যাওয়ার পর নির্দেশ এলো জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজার বাড়িতে ডিফেন্স নেওয়ার জন্য।এখানে ৫ দিন থেকে একাধিক যুদ্ধ করি। এখানে থাকতেই হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পন করে। ৫ দিনের দিন রাত ১০টায় আমাদের কাছে খবর এলো প্রখ্যাত চলচিত্রকার জহির রায়হানসহ ২০০ বাঙ্গালী পুলিশকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে মিরপুরে হত্যা করেছে।আমরা এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে মিরপুরের দিকে রওয়ানা হই। আমরা ভোর ৪টা সময় মোহাম্মদপুর এসে ডিফেন্স নেই। সকাল ৭টায় আমরা ফোর বেঙ্গলের পূর্ব থেকে ঢাকায় অবস্থান করা কমান্ডগুলোও এক সাথে তিন দিক দিয়ে আক্রমন করি। এ সময় মিরপুর বিহারী ক্যাম্পের সকল লাইন আমরা কেটে দেই। তারা আমাদের ত্রিমুখী আক্রমনের মুখে বিকালে গিয়ে আত্মসমর্পন করে। এরই মধ্যে তাদের কতজন যে মারা গেছে তার কোন হিসাব নেই। সম্ভবত আমাদের মিরপুর যুদ্ধটি ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। কারণ, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মিরপুর কিন্ত স্বাধীন হয়নি।

পরিচয় : সৈয়দ নজির আহমেদ। পিতা সৈয়দ মতি মিয়া হাজী এবং মাতা রাবেয়া খাতুন। কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলার ৪নং আমড়াতলী ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়।
১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর সৈয়দ নজির আহমেদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ১০৫ রুমষ্টেকশন ব্যাটালিয়নের গিলগিটে থাকতেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে প্রলংকারী বন্যা হলে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সৈনিকদের ৪ মাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে আমি ১৯৭১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দেশে আসি। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। ফলে আমার আর পাকিস্তান যাওয়া হলো না।