যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে মানুষের আত্মচিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দলে দলে মানুষ কুমিল্লা শহর থেকে গ্রামের দিকে আসছে। বর্তমান পালপাড়া ব্রিজের নিচে তখন খেয়াঘাট ছিল। বাড়ির পাশেই দেখা হয় পুলিশ লাইনের হেডক্লার্ক আবদুর রবের সাথে। তাকে নিয়ে দ্রুত খেয়াঘাট যাই। এখানে আসা মাত্রই আবদুল আউয়াল নামে এক পুলিশ সদস্য রবের হাত ধরেই হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিল। এখান থেকে আরো ১০/১২জন পুলিশ নিয়ে গেলাম রবের বাড়িতে। এই সকল পুলিশ গত রাতে কুমিল্লা পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে আসে। এরপর আমরা বাড়িতে থেকেই সমমনাদের সাথে আলাপ করছি কিভাবে যুদ্ধে যাওয়া যায়।এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে কয়েকজন মিলে আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়নের জামবাড়ি এলাকার কোটেশ^র স্কুলে যাই খোরশেদ আলম স্যারের সাথে দেখা করতে। দু:খজনক হলো, খোরশেদ স্যার যাওয়ার পর পাক বাহিনী ঐ স্কুলসহ পাশের বাড়ি গুলো জ¦ালিয়ে দেয়। পরে এলাকায় থেকে কিছু দিন স্থানীয়দের সাথে বিচ্ছিন্ন ভাবে যুদ্ধ করি। এ সময় ব্রাহ্মনপাড়ার টাকই গ্রামের আবদুল মজিদসহ আরো অনেকেই ছিল। আমরা আলতাব আলীর বাড়িতে থেকেই যুদ্ধ করি। পরে মে মাসের মধ্য ভাগে মোতালেব ও রাজ্জাককে নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমারা ক্যাম্পে যাই দুপুরে । এখানে এসে আমরা পেয়ে যাই ময়নামতি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বাশার হায়দারকে(বুড়িচং উপজেলা চেয়ারম্যান আখলাক হায়দারের বাবা)। তিনি আমাকে রেখে অপর দুইজনকে বিদায় করে দেন।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
মে মাসের শেষ দিকে আমাকে আসামের অম্পি নগর ক্যাম্পে পাঠানো হয় প্রশিক্ষনের জন্য। এই প্রশিক্ষন কেন্দ্রে ১৪৫জনকে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। এখানে আমাদের কমান্ডার ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুর রহমান। অম্পিনগর থেকে প্রশিক্ষণ শেষে আবার আমাদের সোনামুড়া ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সোনামুড়া এসে পেয়ে যাই অধ্যক্ষ আবদুর রউফ স্যারকে। সোনামুড়া আবার আমাদের ৬ সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষন দেয় ভারতীয় সেনা বাহিনী। আর আমাদের দেশীয় প্রশিক্ষক ছিলেন সিলেটের কর্নেল মজুমদার । এখানে আমরা হ্যান্ড গ্রেনেড,থ্রি নট থ্রি রাইফেল,এসএলআর,এলএমজিসহ নানা প্রশিক্ষন দেই।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রশিক্ষনের পর জুলাই মাসে প্রথম আমাদেরকে যুদ্ধ করার জন্য কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়নের কোটেশ^র পাঁচগাছিয়া দরগার কাছে পাঠানো হয়। এখানে আমরা ডিফেন্স করি। এর মধ্যে আমরা অম্পিনগর থেকে মতি নগর সাব সেক্টরের অধীন চলে আসি । এখানে আমাদের কমান্ডার ছিলেন লে.দিদারুল আলম। সাথে ছিলেন নায়েক সুবেদার আফজল হোসেন,নায়েক সুবেদার আবু সামা,হাবিদাল মনির। আমরা ছিলাম ২নং সেক্টরের অধীন। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর হায়দার। পাঁচগাছিয়া দরগার ডিফেন্সে আমার সাথে ছিল শাহজাহান,মোমেন,দাউদকান্দির রহিমসহ আমরা ৫জন। এর মধ্যে আমি ছিলাম তাদের নেতা। এখানে আমাদের ডিফেন্সে বেশ কয়েকবারই হানাদার বাহিনী পড়ে যায়। আমাদের সাথে কয়েকটি খন্ড যুদ্ধও হয়। এরপর আবার আমরা মতি নগর চলে যাই।
১৫ আগস্ট আবদুর রব ভুইয়াকে কমান্ডার করে আমাদের ১৫জনকে তিনটি রাইফেল ,২টি এসএমজি,২টি হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে পাঠানো হয়। অস্ত্র সংকট ছিল তীব্র। তাই আমাদের বলা হয়েছে,হানাদারদের কাছ থেকে অস্ত্র লুট করে সেই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করতে। আমরা বুড়িচংয়ের পীরযাত্রাপুর ইউনিয়নের সদরপুরে ক্যাম্প করি। আমাদের কাছে খবর ছিল মালপাড়া ও কুসুমপুর দিয়ে হানাদার বাহিনী আসতেছে। তখন আমরা শশিদলের লতিফ,ইসমাইল ও মোমেনসহ ৭জন ছিলাম। এমন সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সাদকপুরে আমাদের এ্যাম্বুশে পড়েন। শুরু হয় মুখোমুখি তুমুল যুদ্ধ। তারা এক প্লাটুন ছিল। তাদের সৈনিক সংখ্যা দেখে আমরা কৌশল পাল্টিয়ে কিছুটা পিছু হটে পেছন দিক দিয়ে আক্রমন শুরু করি। আমাদের কৌশল কাজে লাগে। হানাদার বাহিনী মনে করছে আমরা চলে গিয়েছি। তাই তাদের গাড়িও চলে যায়। কিন্তু তখনও তাদের ৫জন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। একজন রাস্তার পাশে অস্ত্র তাক করে আছে। আমি পেছন দিক দিয়ে এসে, যেহেতু গুলি ছিল না . তাই, রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় বাড়ি দেই। সাথে সাথে সে ধান ক্ষেতে পড়ে যায় । এ সময় আমাদের সহকর্মীরাও গুলি করতে করতে সামনে চলে আসে। এসে দেখে আরো ৪জন হানাদার বাহিনী ধান ক্ষেতে লুকিয়ে রয়েছে। তখন আমরা তাদের অস্ত্র গুলো নিয়ে দুইজনকে গুলি করে মেরে ফেলি আর ৩জনকে ক্যাম্পে সোর্পদ করি।
আমরা পাকিস্তানী সৈনিককে মেরে ফেলেছি এই খবর বুড়িচং পৌঁছলে হানাদার বাহিনী পুরো শক্তি নিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবার সাদকপুরের দিকে আসে। তখন আমরা আবার পিছু হটে ভারতের মতিনগর ক্যাম্পে চলে যাই। কিন্তু এ সময় তাদের হাতে সাদকপুরে শহিদ হয় আমাাদের হাবিলদার কবির। এই যুদ্ধে আমিসহ আমরা ৭জন আহত হই।
পরিচয় :
হাজী মো. ফরিদ উদ্দিন,পিতা মৃত মো. লাল মিয়া ও মাতা মৃত রাজধন নেছা। ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের খাড়াতাইয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ৬ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান ৭ম। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ার সময়ই তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তিনি যখন ছাত্রলীগ করেন, তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ভিপি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দেশের জাতীয় পতাকার রূপকার শিবনারায়ন দাস। পরবর্তী পর্যায়ে বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। বর্তমানে তিনি জাসদ কুমিল্লা জেলার সহ সভাপতি ও বুড়িচং উপজেলার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৮১ সালে তিনি মোসাম্মত ফেরদৌসী বেগমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি বর্তমানে এক ছেলে ও এক কণ্যা সন্তানের জনক।