হাসিনা ও তার পরিবারের নামে অপচয়কৃত প্রকল্পের বিবরনী

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের চাপে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এসব প্রকল্প যাতে সহজে পাস করানো যায়, সে জন্য কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিল শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম। কিছু প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হলেও কাজে আসছে না। এতে সরকারি টাকার অপচয় হয়েছে।
শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে গত ১৫ বছরে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ, বাকি ৪৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে।
প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল বিনোদনকেন্দ্র, সাফারি পার্ক, দৃষ্টিনন্দন ভবন, নভোথিয়েটার, আইসিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠার নামে। প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, ছেলে শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের নামে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নামে আরও ৪৩টি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। এগুলো অনুমোদনের আগেই সরকারের পতন হয়।
পদত্যাগ করার তিন মাস আগে একটি একনেক সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের নামে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম না দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত ৯ মে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় তিনি বলেন, নিজের নাম ব্যবহার করে যাতে আর প্রকল্প না নেওয়া হয়। তবু নাম দেওয়া থামেনি। অতি উৎসাহী প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে প্রকল্প নিয়েছিলেন। সরকারি নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া ৮২ প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্প থেকে। এর বাইরেও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টসহ (বিসিসিটি) সরকারের অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে প্রকল্প নিয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে আরও অনেক স্থাপনা করা হয়েছে গত ১৫ বছরে।
পরিকল্পনা কমিশনের এডিপি বই পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপনে। ১২টি প্রকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি নাম ব্যবহার হয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রকল্পে ১১টি। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আটটি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাতটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের ছয়টি প্রকল্প।
জেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ পরিবারের নামে নেওয়া বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তা কাজে আসছে না। স্থাপনা নির্মাণ করার পর পড়ে আছে। কোথাও জনবলের অভাবে অবকাঠামো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আবার কোথাও ওই প্রকল্পের আবেদনই ছিল না। এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রীদের চাপে, কোথাও রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোথাও সরকারের উৎসাহী কর্মকর্তাদের প্ররোচনায়, কোথাও ঠিকাদারদের পরামর্শে। ফলে এসব প্রকল্পে কোন খাতে কত ব্যয় হচ্ছে, সে প্রশ্ন তোলার সাহস কেউ করেনি।
গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার নামে একটি ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট ‘শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম বাদ দিয়ে শুধু ‘জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের নাম পরিবর্তন নিয়ে একটি নীতিমালা করা হচ্ছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা জানিয়েছেন। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার বিষয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। এ কারণে প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প পরিহার করতে হবে। গুরুত্ব অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা তৈরি করতে পরিকল্পনা কমিশনকে নির্দেশ দেন তিনি।
যে সকল প্রকল্প কাজে আসছে নাঃ

শেখ হাসিনার নামে ২০১৭ সালে যশোরে একটি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল ৩০৫ কোটি টাকা; কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে এই পার্ক করা হয়, তা পূরণ হয়নি। এই পার্ক কাজে আসছে না। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। লোকসান ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত সফটওয়্যার পার্কে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে।
শেখ কামালের নামে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর উদ্বোধন করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১১৭ কোটি টাকা। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ইনকিউবেটরটি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। অনেকটা ‘অব্যবহৃত’ পড়ে আছে সুরম্য ভবন, কম্পিউটার ও ডরমিটরি।
চুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও ইনকিউবেটরের প্রথম প্রকল্প কর্মসূচি পরিচালক মীর মুহাম্মদ সাক্বী কাওসার প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বয় ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এটি কাজে আসছে না।ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা তৈরি করা এবং বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে সহযোগিতা করা; কিন্তু এত বছরেও সেটি হয়নি। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইনকিউবেটরটি উদ্যোক্তাদের জন্য কার্যকর করতে পারেনি। কার্যত এখনো অলস পড়ে আছে।
সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কও বেহাল। গত বছর সিলেট হাইটেক পার্ক উদ্বোধন করা হয়। তবে সেখানে আইসিটি, টেলিকমিউনিকেশন এবং আইসিটি–নির্ভর শিল্পের জন্য প্রতিষ্ঠিত আইটি পার্ক হওয়ার কথা। অথচ পার্কটিতে জমি বরাদ্দ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় মূলত ইলেকট্রনিক, হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতেরই প্রাধান্য। স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে এটা নিয়ে হতাশা সিলেটের পার্কে রহমানিয়া সুপারমার্কেটের নামে ১ দশমিক ৮ একরের বেশি জমি বরাদ্দ দেওয়া আছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সৈয়দ মহসিন আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা বোট ক্লাব, রেস্তোরাঁ ও হাসপাতাল তৈরি করবেন।
পার্কটি থেকে এক একর পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ নিয়েছেন ইএলবি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের প্রথমে ডেটা সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও এখন তা আর করা হবে না। তবে অন্য কিছু হয়তো সেখানে হবে।
শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে যখন প্রকল্পগুলো অনুমোদন করা হয়, সেই সময়ের দুজন সচিবের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। অবসরে যাওয়া এই দুই সচিবের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইসিটিকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হতো।
আন্তমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থিত অনেকেই অস্বাভাবিক খরচের বিষয়টি বুঝতে পারতেন; কিন্তু প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম থাকায় প্রকল্পের উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তা কিংবা অস্বাভাবিক খরচ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো পরিবেশ ছিল না।
আরেকজন সচিব বলেন, শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে প্রকল্পগুলো আটকানো যেত না। এসব প্রকল্পের পেছনে ছিলেন প্রভাবশালীরা। তাঁরা নিজের এলাকার জন্য প্রকল্পগুলো পাস করে নিতেন। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও একটা অংশ ছিল, যারা শেখ পরিবারের নাম ব্যবহারের সুযোগ নিত।