কোটা সংস্কার আন্দোলনের ২৮৯ মামলা থেকে ৩হাজার জন কে অব্যাহতি

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীতে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার উচ্চমাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত তিন হাজার ব্যক্তি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। ২২৮ মামলায় গ্রেপ্তার এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ না পেয়ে অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। সম্প্রতি ঢাকার আদালত পুলিশের ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন।

পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাগুলো ঘটেছে। তবে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ওই সব ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পুলিশ পায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মহানগরের বিভিন্ন থানায় ২৮৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৬১টি ছিল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা। বাকি ২২৮টি মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ। এসব মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘর্ষ-সংঘাতের ঘটনায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তিন হাজারের বেশি ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট জামিনে কারামুক্ত হন তাঁরা।

মামলা থেকে অব্যাহতির বিষয়ে বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ গতকাল শনিবার বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে হয়রানিমূলক মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ যেসব নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

একই কথা জানান জামায়াতের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ারসহ দলের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁদের অপরাধের সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, যেকোনো ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়া যায়, তখন পুলিশ তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে থাকে। কোটা সংস্কারের সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা যদি পুলিশ না পায়, সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হবে, এটাই স্বাভাবিক।

শিক্ষার্থীসহ যারা অব্যাহতি পেলেন

গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে। এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় করা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে গত ২১ জুলাই মামলা করেছিল পুলিশ। মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল, কোটা সংস্কারের দাবিতে ১১ জুলাই বিকেলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। খবর পেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শিক্ষার্থীরা পুলিশ সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। ইটের আঘাতে পুলিশের দুই সদস্য রক্তাক্ত ও জখম হন। আরও অনেক পুলিশ সদস্য ইটের আঘাতে আহত হন। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা ধাওয়া দিলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

এ মামলায় গত ১৪ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে দিন তাৎক্ষণিকভাবে কোটা আন্দোলনে সম্পৃক্ত কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে পুলিশ মামলা করে। মামলার তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই এজাহারনামীয় আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিক্ষার্থীর বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন থানার মামলায় গ্রেপ্তার অন্তত ৪২ জন উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এ ছাড়া অব্যাহতি পাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় গত ২০ জুলাই দুই থেকে তিন হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছিল পুলিশ। ওই মামলায় পুলিশ ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। অবশ্য ১৫ আগস্ট তাঁদের সবাইকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা রাস্তা বন্ধ করে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুর করে এবং আগুন দেয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) প্রবীর রঞ্জন ধর বলেন, মেট্রোরেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা সত্য। তবে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাননি তিনি।

বারিধারা এলাকায় গত ১৯ জুলাই বোমা বিস্ফোরণসহ নাশকতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ভাটারা থানা-পুলিশ। তবে তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে গত ১৫ আগস্ট ঢাকার আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। ওই আবেদনে বলা হয়, নাশকতার ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

একইভাবে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম খান, জহিরউদ্দিন স্বপন, শামসুর রহমান (শিমুল বিশ্বাস), রুহুল কবির রিজভী, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, রশিদুজ্জমান মিল্লাত, সুলতান সালাউদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, আমিনুল হক, নাসিরউদ্দিন আহমেদ অসীম ও নিপুণ রায় চৌধুরী। জামায়াতে ইসলামীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, মিয়া গোলাম পরওয়ার ও মোবারক হোসাইন। এ ছাড়া বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান (পার্থ), এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণ অধিকার পরিষদের নুরুল হকসহ অন্যান্য নেতা। এসব নেতা-কর্মীকে সেতু ভবন, বিটিভি ভবন ও মেট্রোরেলে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদনগুলোয় বলা হয়েছে,

এসব হামলার সঙ্গে এই নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল গতকাল বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গণগ্রেপ্তার করেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, বিগত হাসিনা সরকারের সময় একের পর এক বিএনপিসহ বিরোধী দল ও মতের মানুষের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এখনো সেসব মামলার ঘানি টেনে চলেছেন তাঁরা। এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান বিএনপির এই নেতা।