বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পোনে বারটার দিকে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। প্রথমে একটি ছোট গর্ত দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর প্রবল স্রোতে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে প্লাবিত করে দেয় বুড়িচং উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন। ঘুমন্ত মানুষগুলো চোখ খোলার আগেই দেখল তার শিয়রে পানি হাবুডুবু করছে। শুরু হয় এলাকা জুড়ে গণচিৎকার। এত রাতে মসজিদ বন্ধ থাকায় তাৎক্ষনিক মাইকে সতর্কও করা যায়নি। যখন সময় হয়েছে সতর্ক করার তখন প্লাবিত হয়েছে পবিত্র মসজিদগুলোও।
গত তিন দশকের ইতিহাসে এই প্রথম স্মরণকালের এই ভয়াভহ বন্যায় বুড়িচং ও ব্রাহ্মনপাড়া উপজেলার প্রায় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পাশের দুই উপজেলা আদর্শ সদর ও দেবিদ্বারও।
দেবিদ্বার উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হলেও আশ্রয় কেন্দ্র গুলো কার্যকর করার জন্য ছিল না প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেসরকারি ত্রান দেওয়া সংগঠনগুলোর সাথে সমন্বিত কোন উদ্যোগ। যার কারণে, কোন কোন আশ্রয় কেন্দ্র একাধিক ত্রান পাইলেও কোন কোন কেন্দ্র আবার কোন ত্রান না পেয়ে তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। নিম্মাঞ্চলের মানুষদের উদ্ধার করতে বেশ হিমশিত খেতে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের।
কারন, প্লাবিত এলাকাগুলোতে উদ্ধার কাজ চালানোর মতো কোন নৌকা কিংবা স্পিডবোর্ড ছিল না। গতকাল শুক্রবার কিছু নৌকা , ট্রাক এবং স্পিডবোডের সহায়তায় ভানবাসী মানুষকে উদ্ধার করা গেলেও অনেক নিম্মাঞ্চলের মানুষদের উদ্ধার করা যায়নি। কারণ, সেখানে স্পিডবোড ছাড়া যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যার কারণে শুক্রবার দিনভর প্লাবিত মানুষগুলোর কান্না ভেসে আসছে আকাশে বাতাসে।
এ দিকে,বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আশপাশের মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার জন্য। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরাও সাধারণ জনগণকে সহায়তা করছেন।
বাঁধ ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বুড়িচং উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শিদা আক্তার। তবে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু.মুশফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত বারটায়ও বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কথা অস্বীকার করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান স্বীকার করেছেন। জেলা প্রশাসক কেন অস্বীকার করলেন তা জানা যায়নি।
এ দিকে, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়ায় গোমতীর বাঁধ ভাঙায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চার লক্ষাধিক মানুষ। ভাঙা অংশ দিয়ে এখনও পানি ঢুকছে লোকালয়ে। এতে বুড়িচং উপজেলার সাথে, আদর্শ সদর উপজেলার একাংশ, ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বুড়িচং উপজেলার ৩৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। শুক্রবার বাদ মাগরিব এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের শুক্রবার সকাল ১০টায় তৈরি করা শিটে উল্লেখ করা হয়েছে,উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৬০ হাজার পরিবার বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এক লক্ষ ৭০ হাজার। ৩৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনী কয়েকটি গ্রামে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে। সরেজমিন বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়ায় গোমতীর বাঁধ ভাঙা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এলাকা সংলগ্ন বাঁধে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা অবস্থান নিয়েছেন। অনেকে তাদের গবাদি পশু নিয়ে এসেছেন।
এদিকে, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুকনো খাবার বিতরণ করলেও বিশুদ্ধ পানি এবং শৌচাগারের সংকট রয়েছে। কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, বুড়িচংসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করছি।
এ দিকে , গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকার কারণে গতকাল শুক্রবার সকালের দিকে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হলেও সন্ধ্যার পর দুই উপজেলা এবং আদর্শ সদর ও দেবিদ্বার মিলিয়ে প্রায় অর্ধশতের উপর গ্রাম প্লাবিত হওয়া খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জানা গেছে।
সকালের দিকে প্লাবিত গ্রামগুলো হলো বুড়বুড়িয়া, খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজার, কিং বাজেহুরা, মিথিলাপুর, শিকারপুর, মহিষমারা, ইছাপুরা, পয়াত, গাজীপুর, কণ্ঠনগর, মাওরা, গোপীনাথপুর, জগৎপুর ও গোসাইপুর।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশরী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান। তিনি জানান,বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ওই স্থানের নিচ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু রাত পৌনে ১২টার দিকে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে।
পাউবো কর্মকর্তারা বলেছেন, গত দুই দিনে পানি বাড়ার হিসাব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। গতকাল বিকেলে পানি বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে। ১৯৯৭ সালে নদীটিতে বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল।
পানির তোড়ে ভাঙনের খবরে বাঁধের আশেপাশের শতাধিক পরিবার নিজেদের ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবার সকাল আটটায় সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়বুড়িয়া গ্রামের শতাধিক বাসিন্দা বাড়িঘর হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায় আছে।
বুড়বুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী গোলাম কিবরিয়া জানান, তাঁর বাড়িঘর সব পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব বলতে গিয়ে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
বুড়বুড়িয়া গ্রামের অন্তত ২০ জন বাসিন্দা জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় নদীর পানিতে হঠাৎ ঘূর্ণন শুরু হয়। তারপরই বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। প্রথমে বাঁধটি ১০ ফুটের মতো ভাঙে। তারপর ২০ ফুট করে বড় আকারে ভেঙে যায়। পরে এটা ৫০ ফুটের উপর চলে যায়।
বন্যা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন নানুয়ার বাজার গ্রামের গৃহবধূ আইরিন আক্তার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সপরিবার তাঁদের ঘর ছাড়তে হয়েছে। কান্না করতে করতে তিনি বলেন, ‘১২ বছরের সংসারটা সাজানো–গোছানো ছিলো। পানি সব নিয়ে গেল।’
এদিকে, সরেজমিনে শুক্রবার (২৩ আগষ্ট) বুরবুড়িয়া বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লোকালয় তলিয়ে গিয়েছে পানিতে। প্রবল স্রোতে বেড়িবাঁধের গাছগুলো একের পর এক ভেঙ্গে স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলে যাচ্ছে। এসময়, স্থানীয়রা লোকজনদেরকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। কেউ কেউ নিজেদের আসবাবপত্র ও গৃহপালিত পশু নিয়ে বসে রয়েছেন বেড়িবাঁধে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে অবসন্ন হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তাদের বসতভিটার দিকে। এদিকে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধার কাজ করছে সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবী। বিভিন্ন স্পিড বোড ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এদিকে, স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে মিথিলাপুর এলাকার দুইটি আশ্রয় কেন্দ্রও নিচতলা পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। এতে আশ্রয় কেন্দ্রের মানুষদের ভোগান্তিও পৌঁছেছে চরমে। জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। এছাড়াও, গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কুমিল্লা শহরে বসবাসকারী মানুষররাও। এদিকে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, গোমতীর বাঁধ ভাঙায় তলিয়ে যেতে পারে গোটা শহর।
জীবন ঝুঁকির কথা প্রকাশ করে ভুক্তভোগী এলাকাবাসীরআ বলেন, আমাদের আপাতত ত্রাণ লাগবে না ভাই। আমাদের জীবন বাঁচান আপনারা। প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন। আমাদের অনেক মানুষ বাড়িতে আটকা পড়ে আছে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করবো আপনারা স্পীড বোট দিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেন।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুল লতিফ বলেন, বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতীর বাঁধে ধসের ঘটনা ঘটেছে। ফলে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। আমরা গত কয়েকদিন ধরেই স্থানীয় মানুষজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে আসছি। আমাদের টিম কাজ করছে। এছাড়াও, বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করার কারণে গোমতী নদীতে পানির উচ্চতা কমছে। শুক্রবার দুপুর ২ টা পর্যন্ত পানি বিপদসীমা থেকে ২৫ সেন্টিমিটার থেকে কমে ১০৯ সেন্টিমিটার এ এসেছে।
এদিকে জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আর তেমন ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আশা করি আবহাওয়া অনুকূলে আসার কারণে পানির চাপও কমবে।