কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে বৈশাখ মানেই কাতলা মাছের মহোৎসব চলছে। শত বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যে এখনো টিকে আছে প্রাণচাঞ্চল্য। নানা বয়সী মানুষদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে কুমিল্লার অন্যতম পুরাতন এই হাট, যেখানে মাছের গন্ধে, হাঁকডাকে, দর কষাকষিতে মেতে ওঠে রাজগঞ্জ বাজার।
প্রতিবছরের মতো এবারও পয়লা বৈশাখের দিন থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনের কাতলা মাছের মেলা। গত সোমবার সকাল থেকেই রাজগঞ্জ বাজার ও আশপাশের এলাকায় ভিড় জমাতে থাকেন বিভিন্ন জেলার মাছ বিক্রেতা ও উৎসুক জনতা। গতকাল আজ মঙ্গলবার রাত ১২ টা পর্যন্ত মূলত কাতলা মাছের মেলা হলেও দেখা যাবে রুই, মৃগেল, আইড়, শোল, টেংরা, পুটি, চিংড়ি সহ নানা জাতের বড় মাছ।
রাজগঞ্জ বাজারের প্রবীণ মাছ ব্যবসায়ী মো. সাদ মিয়া বলেন, “বছরের এই দিনটির জন্য ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষা করেন। বড় মাছ তুলে রাখেন এই মেলায় বিক্রির জন্য। কেবল কুমিল্লা নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্রেতা ও বিক্রেতা আসেন এখানে।”
৩ কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি পর্যন্ত কাতলা মাছ বিক্রি হচ্ছে হাটে। মাছের আকার আর চাহিদার ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারণ করছেন বিক্রেতারা। কেউ ১ হাজার টাকায় এক কেজি মাছ কিনছেন, কেউ আবার ৫০০ টাকায় দর কষাকষি করছেন মাঝারি মাপের কাতলার জন্য। জীবিত মাছ হলে দাম আরও কিছুটা বেশি। পুকুরে চাষ হওয়া তাজা মাছের কদর বাড়তি।
দেবিদ্বার থেকে মাছ নিয়ে আসা মন্টু দাস বলেন, “আমার পুকুরে বিশেষভাবে বড় কাতলা মাছ চাষ করি এই মেলার জন্যই। এবছর ২০০টির মতো মাছ এনেছিলাম। সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে বেশির ভাগই বিক্রি হয়ে গেছে।”
মেলায় আসা এক ক্রেতা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, “প্রতিবছরই এই মেলায় আসি মাছ কিনতে। এবছর মাছের দাম একটু চড়া, তবে মাছের মান ভালো। বড় মাছগুলো দেখে মন ভরে যায়।”
শুধু মাছ কেনা নয়, মেলাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক উৎসবের আমেজ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কেউ এসেছেন মাছ দেখতে, কেউবা ছবি তুলতে। কেউবা শুধু ঐতিহ্যের সাক্ষী হতে।
বিষ্ণুপুর এলাকার বাসিন্দা শাহানুল হক বলেন, “৪০ বছর ধরে আমি এই মেলায় আসি। বৈশাখ মানেই রাজগঞ্জের মাছ। এই হাট আমাদের আত্মীয়তা, স্মৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ।”
ঐতিহাসিক গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “রাজগঞ্জের কাতলা মাছের মেলা কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর বয়স শত বছরের বেশি হলেও এখনো এর আবেদন কমেনি। বহু পরিবার এই মেলার বড় মাছ দিয়েই আত্মীয়স্বজনকে আপ্যায়ন করেন।”
রাজগঞ্জের এই কাতলা উৎসব তাই কেবল একটি হাট নয়—এটি হয়ে উঠেছে গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর বৈশাখী আবেগের মিলনমেলা।