পরিশ্রমী সাংবাদিকতা: উন্নয়ন সংবাদ বনাম অনুষ্ঠান নির্ভর সংবাদ -শাহাজাদা এমরান

সময়ের কথা
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ২ years ago

আজ কালকার সাংবাদিকরা পরিশ্রম করতে চায় না। মাঠে যেতে চায় না। উন্নয়ন সংবাদ থেকে অনুষ্ঠান নির্ভর নিউজকে প্রাধান্য দেয়। কারণ উন্নয়ন নিউজে সমাজ তথা দেশের কল্যাণ বেশি হয় এবং সাংবাদিকতা বিকশিত হয়। আর অনুষ্ঠান নিউজে মেধার খুব একটা কাজ নেই। শুধু নামগুলো লিখে বিষয়টা লিপিবদ্ধ করলেই নিউজ হয়ে যায় এবং নগদ সম্মানিও থাকে। অনুষ্ঠান নিউজ সব সময় যে একই রকম হয় তা বলছি না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাই। এতে শিখারও খুব একটা কিছু থাকে না আবার সাংবাদিকতার প্রকৃত আনন্দও অনুভব করা যায় না। অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট মিডিয়াগুলোও বঞ্চিত হচ্ছে উন্নয়নধর্মী ভালো নিউজ থেকে।

এক সময় নঈম আজাদ, আবদুল্লাহ আল মামুন ও বাকীন রাব্বী ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ছিলাম চৌকশ টিম আমোদ। কুমিল্লার অধিকাংশ সাংবাদিকগণ অপেক্ষায় থাকত বৃহস্পতিবারের আমোদ এর জন্য। কারণ আমোদ থেকে উন্নয়ন নিউজগুলো নিয়ে নিজেদের মত করে ঢাকার পত্রিকায় কুরিয়ার বা ফ্যাক্সে পাঠাতেন তারা। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক অসংখ্যবার আমাকে বলছেনও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে যে, তোমাদের নিউজগুলো আমি ব্যবহার করি।

বাকীন ভাই সব সময় উন্নয়নধর্মী সংবাদের প্রাধান্য দিতেন। দুই টাকা দামের একটা গোল বন খেয়ে সারা দিন শহর কুমিল্লা বা শহরতলীতে হেঁটে বেড়াতাম। এমনকি রোজা থেকেও পুরাতন চৌধুরীপাড়া আমোদ অফিস থেকে বিবির বাজার স্থলবন্দর হেঁটে গিয়ে ও এসে নিউজ করেছি। বাকীন ভাইয়ের দেওয়া ভাড়াটা পকেটে রেখেছি প্রয়োজনে খরচ করার জন্য। এটা বলছি ৯০ দশকের শেষ দিকের এবং ২১ শতকের গোড়ার দিকের কথা।

কুমিল্লা শহরের নুরপুর চৌমুহনীতে থাকতাম নূর নিবাসে। কোকাকোলা নিয়ে কি এক নিউজ করতে হবে বললেন বাকীন ভাই। নুরপুর থেকে আলেখারচর বিশ্বরোড হেঁটে গিয়েছি ও এসেছি। সম্পাদককে বুঝতেও দেইনি কি কষ্ট করে নিউজটি নিয়ে এসেছি। নাম মনে নেই। কোকাকোলার ঐ অফিসার একটা খামে কিছু একটা দিতে চেয়েছিলেন। বিনয়ের সাথে তা ফেরত দিয়ে বলেছি, বাকীন ভাই আমাকে ভাড়া দিয়েছেন। ধন্যবাদ। তখন আমি আমোদ এ আসার আগেই কোকাকোলার ঐ অফিসার ফোন করে আমার খাম ফেরত দেওয়ার কথা বাকীন ভাইকে বলেছিলেন। আজকাল সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে এটা অনেক আগের কল্পকাহিনী মনে হতে পারে।

তাই চলতি আগস্ট ২০২৩ এর প্রথম সপ্তাহের একটি ঘটনা বলছি। কুমিল্লা নগরীর একটি বিশেষায়িত সরকারি অফিসে গেলাম নিউজের জন্য। কর্মকর্তা চমৎকার আপ্যায়ন করলেন। নিউজের তথ্য দিলেন। বিনয়ের সাথে বললেন, সম্পাদক সাহেব এসেছেন। আর কি করতে পারি। একটু কষ্ট করে হিসাব শাখাটা হয়ে যাবেন প্লিজ। ভাবছি বিজ্ঞাপন দিবে। ওমা ! গিয়ে দেখি সাদা খাম। হিসাব রক্ষক বললেন, ম্যাডাম দিয়েছেন মিষ্টি খাওয়ার জন্য। বললাম, এই অফিসে আমার যাতায়াত ২০০২ সাল থেকে একটি নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু কখনো এমনটা হয়নি। সরি। পরে ঐ সরকারি কর্মকর্তা ফোন করে জানালেন, এমরান ভাই, আমার গত ৮/১০ মাসে প্রায় ২২/২৩ জন সাংবাদিক এখানে এসেছেন। এর মধ্যে আপনিই ফেরত দিলেন। মনে থাকবে, ধন্যবাদ।

জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাপ্তাহিক নতুনপত্রের সম্পাদক আনোয়ারুল কাদের বাকী ভাই। বাকী ভাইয়ের অনেক অনুরোধেও নতুনপত্রের প্রথম তিন বছর এক টাকাও সম্মানি নেইনি। টিউশনি করে যা পেতাম তা বিতর্ক পরিষদের জন্য ব্যয় করতাম। অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছি। পেটে ক্ষুধা রেখে বাকী ভাই এর টাকা ফেরত দিয়ে বলতাম, ভাইয়া আমাকে আরো বেশি করে এ্যাসাইনমেন্ট দেন। আরো নিউজ করতে চাই। বিনয়ের সাথে টাকা ফেরত দিতাম। এক সময় মহিউদ্দিন মোল্লা নতুনপত্রে আমার সহকর্মী হয়। একদিন বাকী ভাই, মহিউদ্দিন মোল্লাকে বলেন, শাহাজাদাকে টাকা দিতে চাই। সে যে টাকা নিতে চায় না। শাহাজাদা এমরান কি খুব বড় লোকের ছেলে? আমি জানি আমি কত নম্বর বড় লোকর ছেলে? স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতার সাথে সংগ্রাম করে বেড়ে উঠা ছেলে আমি। তখন আমার ধারণা ছিল, যদি সম্পাদক থেকে টাকা না নেই, তিনি আমাকে আদর করে আরও বেশি এস্যাইনমেন্ট দিবেন, নিউজ লিখতে বলবেন। কারণ,আমি সব সময় অর্থকে নয়, সাংবাদিকতাকে প্রাধান্য দিতাম। বিশ্বাস করতাম এবং এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, টাকার পেছনে ঘুরলে ভালো সাংবাদিক হওয়া যাবে না, আর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের পেছনে ঘুরলে অর্থ প্রকৃতি থেকেই চলে আসবে। ইনশাল্লাহ্ হয়েছে এবং হচ্ছেও তাই।

মহান আল্লাহর রহমতে আজ হলফ করে বলতে পারি, আজ আমি শাহাজাদা এমরান শুধু যে, সাংবাদিকতা করে নিজে খাই তা নয়, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর মিলিয়ে প্রায় ৫২জন সংবাদকর্মী আছেন যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে আমাদের কুমিল্লা ও কুমিল্লার জমিন এর উপর কিছুটা হলেও তাদের সংসার নির্ভরশীল।

এ সময়ে সাংবাদিকদেরই যে, আমি কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছি তা নয়, বিভিন্ন উপজেলার অনেক পত্রিকার সম্পাদক আছেন যাদের হাতেখড়ি হয়েছে আমার হাত দিয়ে। এটা ভেবে আমি মহান রবের কাছে শত কোটি শোকরিয়া জ্ঞাপন করি।

অভাব,অনটন,অভিযোগ ও অনুযোগ এখনো আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু অভাব আমাকে কখনো লোভের কাছে পরাভূত হতে দেয়নি। নিজের ছেলের জন্য দুধ আনতে মধ্যম আশ্রাফপুর থেকে টমছমব্রিজ পাঠাল জীবন বন্ধু। দুধ কিনব এমন সময় বাকীন ভাইয়ের ফোন। কোথায় তুমি? ভাইয়া, টমছমব্রীজ। দ্রুত এখন আমোদে আসো। একমাত্র ছেলের দুধ কিনা রেখে ছুটে গিয়েছি আমোদ এ বসের কাছে। জানতে কিংবা বুঝতেও দেইনি, বাকীন ভাইকে, দুধ কিনা রেখে আপনার ডাকে চলে এসেছি। শুধু এতটুকু মেনে চলছি যে, বস অলওয়েজ রাইট। শুধু জীবন বন্ধুকে বলেছি, আমোদ এ যাচ্ছি। কষ্ট করে আবিরের জন্য দুধটা ব্যবস্থা করিও। হাসি মুখে জীবন বন্ধুও এই অত্যাচার মেনে নিয়েছে । হয়তো এজন্য যে, সে কর্মজীবী হওয়া সত্ত্বেও আমার কর্মকে সেও নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিয়েছে।

বাকীন ভাইয়ের সাথে আমোদ টেবিলে বসে আদবের সাথে অনেক তর্ক করেছি, অনেক সিদ্ধান্তে দ্বিমত করেছি, শুধু মাত্র আমোদ এর স্বার্থে। কারণ, আমোদকে কখনো মনে করিনি এটা আমার চাকুরি। মনে করেছি এটা শুধু বাকীন ভাইয়ের আমোদ না, এটা আমার নিজের পত্রিকা। প্রথমে রাগ করলেও পরে এটা নিশ্চয়ই ভাইয়া উপলদ্ধি করতেন। জনাব বাকীন রাব্বীর মত বস পাওয়া এ জীবনে হয়তো সম্ভব না। তিনি আর্থিক ভাবে খুব ধনী না হলেও মনের দিক থেকে ছিলেন বিলগেটসের থেকেও অনেক বড় ধনী। আমরা সহকর্মীরা তার স্নেহের পরশে চেষ্টা করেছি নিজকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে।

জীবনের শুরু থেকে এই লেখা লেখা পর্যন্ত যখন যেখানে কাজ করেছি, ঠিক তখন সেখানকার সেই প্রতিষ্ঠানকে মনে করেছি নিজের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সন্তান হওয়ার আগে কর্মরত প্রতিষ্ঠানকে তুলনা করতাম বাবা-মা’র সাথে আর বিয়ের পর সন্তান হওয়ার পর বর্তমানের প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে করি আমার আবির-দিবার মত। যাদের সাথে শুধু ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতার বিনিময় হয়, বেঈমানি করা যায় না। যার কারণে আল্লাহ রহমতে আজ পর্যন্ত কর্মরত কোন প্রতিষ্ঠান আমাকে ছাড়তে হয়নি, যদি না আমি ছেড়েছি। আর এ পর্যন্ত যে সকল প্রতিষ্ঠান আমি ছেড়েছি সেই সব গুলো প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে আমার অদৃশ্যের ভালোবাসার হাত। যার ফলে তাদের নতুন সংবাদকর্মী নিয়োগে এখনো আমার ইশারা দিতে হয়। কারণ, এটা যে উভয় উভয়ের পরিশিলিত ও স্বার্থহীন অকৃপণ ভালোবাসার দায়বদ্ধতা।

লেখাটি শুরু করেছিলাম দু’লাইনের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য। কিন্তু লিখতে গিয়ে স্ট্যাটাসটি হয়ে গেলো একটি নিবন্ধ। বর্তমান সময়ের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের মনোভাব আর আদব কায়দা দেখলে ঢুকরে কেঁদে বুক ভাসাতে ইচ্ছে করে।

২১ শতকের শুরু থেকেই নগর কুমিল্লায় গানিতিক হারে সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে অনেক সাংবাদিক আমার ভালোবাসার এই শহরে গিজ গিজ করছে। যাদের প্রবল দাপটে অনেক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোতে চেয়ারে বসার সুযোগও পান না অনেক সিনিয়র সাংবাদিকরা। অথচ, অনুষ্ঠানের পরে দেখা যায়, একটি অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ সাংবাদিক যায় শতকরা ৮০ ভাগ সাংবাদিকও নিউজ লেখেন না বা নিউজ দেওয়ার মতও অনেকের মিডিয়া নেই। আবার অনেক সাংবাদিক আছে মিডিয়া আছে কিন্তু নিউজ লিখেন না। অন্য জনের নিউজ কপি করার আশায় বসে থাকেন। আবার অনেকে আছেন, তাদের পত্রিকা আছে,পরিচয় দেন কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করেন না। আবার অনেকে আছেন প্রিন্ট মিডিয়ার পরিচয় দেন, অনলাইন ভার্সনে নিউজ দেন। বিভিন্ন পর্যায়ের হলুদ সাংবাদিকদের কথা আজ নাই বা বললাম। এত নেতিবাচকের মধ্যেও এ সময় অনেক মেধাবী তরুণও এ মহৎ পেশায় সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই তরুণ মেধাবীদের মধ্যে আবার অনেকেরই পরিশ্রম করার মানসিকতা কম। অলস মস্তিকের মেধাবীদের দিয়ে দেশ তথা জাতির তো কিছুই হয় না বরং সে তার নিজের জীবনটাও সঠিক ভাবে উপভোগ করতে পারে না। সুতরাং পরিশ্রমহীন মেধাবীদের আমার পছন্দ নয়। আমার বরং পছন্দ, মেধা কম কিন্তু সে পরিশ্রমী।

ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবুল কালাম বলেছেন। জীবনে উন্নতি করতে হলে বড় কিছু স্বপ্ন দেখতে হবে। কিন্তু এমন স্বপ্ন দেখবে যেই স্বপ্ন তোমাকে ঘুমাতে দিবে না। এমন স্বপ্ন দেখোনা , যেই স্বপ্ন তোমাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করবে।