প্রশাসন নিরব : কুমিল্লা বানিজ্য মেলায় লটারির নামে রমরমা জুয়ার আসর

# প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা লটারি বিক্রি # সর্বস্ব খোয়াচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ # জানেন না পুলিশ সুপার! # মেলার অনুমতি নেয়া হয়নি --জেলা প্রশাসক
শামছুল আলম রাজন ।।
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কুমিল্লা কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় লটারির নামে চলছে রমরমা জুয়ার আসর। প্রকাশ্যে প্রশাসনের নাগের ডগায় প্রতিদিনই এ অবৈধ কর্মকান্ড পরিচলিত হচ্ছে। মেলা উপলক্ষে প্রতিদিন র‌্যাফল ড্র নামে পাঁচটি রঙের ২০ টাকা মূল্যের টিকিট বিক্রি চলছে কুমিল্লার সর্বত্রে। মেলা শুরুর প্রথম দিকে মাইকিং করে কুমিল্লা মহানগরসহ বিভিন্ন উপজেলায় টিকেট বিক্রি করলেও এখন পায়ে হেটে নগরীর অলি-গলি, স্কুল-কলেজের সামনে, গ্রামের পাড়া-মহল্লায় ও হাট-বাজারে পরো দমে চলছে বিক্রি। অবৈধ ভাবে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, স্বর্ণসহ ছোট-বড় বহু পুরস্কারের চটকদার বিজ্ঞাপনে ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করে তাদের কার্যক্রম পরিচালানা করা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন নিরব। এবিষয়ে কেউ কিছুই বলছে না।
এদিকে পুরস্কারের লোভে লাভের নেশায় সর্বশান্ত হচ্ছে নিম¥ আয়ের মানুষ। এই নেশায় ধরেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের। এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের পড়া-লেখায়ও। ঘড়ির কাটা রাত সাড়ে ১০টায় এলেই বই-খাতা রেখে জবুথবু হয়ে মোবাইলে সেটের সামনে বসে পড়েন শিক্ষার্থীসহ নিম¥ আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। একেক জনে এক থেকে দেড়শ টিকেটও ক্রয় করছেন। কেউ কেউ মেলার শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত টিকেট ক্রয় করেই যাচ্ছেন। কিন্তু এর বদৌলতে ভাগ্যে জোটেনি একটি পুরস্কারও। তবুও টিকেট ক্রয় বন্ধ করেননি তারা। এদের বেশির ভাগই রিকশা চালক, দিনমুজর ও বেকার তরুণ। এতে অনেকেই সর্বশান্ত হচ্ছেন। একেই বলে জুয়ার নেশা।
গত ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ভাবে জাঙ্গালীয়া বাস স্ট্যান্ড এলাকায় মেলার উদ্বোধন হয়। চলবে আগামী ১৪ জুন পর্যন্ত। দৈনিক ১২-১৫শ’ টাকা হাজিরায় সিটিকপোরেশনসহ জেলাজুড়ে প্রায় ২৫০ কর্মীর মাধ্যমে লটারীর টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি কর্মী ৮শ’ থেকে ১ হাজার টিকেট বিক্রি করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সে হিসেবে একদিনে টিকেট বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকার।
দীর্ঘদিন ধরে চলা এই কার্যক্রমে প্রশাসনের নীবর ভূমিকা সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের দাবী বাণিজ্য মেলার নামে প্রকাশ্যে জেলা জুড়ে লটারীর নামে টিকিটে বিক্রি করে জুয়া খেলা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায়না। এতে নিঃস্ব হচ্ছে নিম¥ আয়ের মানুষ। পড়া লেখায় মনোযোগ হারাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। লটারীর নামে জুয়ার আসন বন্ধে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নগরবাসী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিকেট বিক্রেতাদের একজন বলেন, মেলা শুরু থেকে বিভিন্ন স্থানে ২৫০-৩০০ কর্মী লটারীর টিকেট বিক্রি করে আসছেন। বিনিময়ে আমাদেরকে ১২-১৫শ’ টাকা হাজিরা দেয়া হয়। টার্গের বেশি বিক্রি করতে পারলে বোনাসও দেওয়া হয়। প্রতিজনে গড়ে ৮শ’ থেকে ১ হাজার টিকেট বিক্রি করি। সে হিসেবে একদিনে টিকেট বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকার।
আশ্রাফুল আলম নামে এক রিকশা চালক বলেন, মামা প্রতিদিন ৩০পিস করে টিকেট নিচ্ছি। টানা ২৫ দিনে একটা সুতাও পায়নি। মোটর সাইকেল ও স্বর্ণের লোভও ছাড়তে পারছিনা। যতদিন খেলা চলবে তত দিন টিকেট কিনবো। দেখি আল্লাহ কপালে কি রেখেছে। আমার মতো এই শহরে শত শত মানুষ যারা টিকেট কিনেই যাচ্ছে। লাভের বেলায় কিছুই পায়নি। এমনও লোক আছে যারা প্রতি দিন দেড় থেকে দুইশ টিকেট কিনে।
টাউনহলের সামনে নুসরাত ফাহিমা নামে এক নারী অভিভাবক বলেন, এক মেলায় সব শেষ করে দিয়েছে। দুই সন্তান নিয়ে শহরে থাকি। একজন পড়ে ৮ম শ্রেণি অপরজন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। তাদের বাবা প্রবাসে থাকে। রাত ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে র‌্যাফল ড্র-এর নাম্বার মিলাতে যায়। বাঁধা দিলে উগ্র আচারণ করে। এদিকে প্রশাসনের নজর দেয়া প্রয়োজন।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ মো. হুমায়ূন কবীর মাসউদ বলেন, লটারির নামে শহর-গ্রামের অলিতে-গলিতে র‌্যাফল ড্র-এর নামে বিক্রি করছে জুয়ার টিকেট। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সারাদিন রিকশা, ভ্যান চালিয়ে নিম¥ আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের সর্বশেষ সম্বলটি লুটে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর আনন্দ ফুর্তির নামে স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে আড্ডা আর গ্যাংয়ের নামে নানান অপকর্মের সঙ্গে। প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ থাকবে এখনই এর লাগাম টানুন। অন্যথায় বিপথে যাবে যুবসমাজ, কষ্ট পাবে খেটে খাওয়া মানুষের পরিবার।
কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও গণমাধ্যম কর্মী মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, বাণিজ্য মেলায় লটারীর নামে জুয়া চলছে। এমন কান্ড আগেও ঘটেছে। তখনও গণমাধ্যম স্বোচ্চার হলে কর্তৃপক্ষ এমন অনৈতিক আয়োজন বন্ধ করে মেলা চালায়। এবার আবার প্রকাশ্যে লাইভ করে প্রতিরাতে জুয়ার লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়। রিকশা চালক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ হুমড়ি খেয়ে লটারি টিকেট কিনে লাভের লোভে সর্বনাশা জুয়ায় সব খুয়াচ্ছেন। এই মেলার অনুমতি পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন থেকে নেয়া হয়নি। প্রশাসনের সামনে এমন আয়োজন চললেও কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। না হলে জুয়ার আয়োজনে যে ভাবে সাধারণ মানুষ মেতেছে এবং আয়োজকরা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জেলা প্রশাসকের উচিত এই কার্যক্রম বন্ধে এখনই পদক্ষেপ নেয়া।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম বলেন, বর্তমান প্রশাসন কোন কাজটা সঠিক ভাবে করছে?। তাদের সামনেই অবাধে গোমেতীর মাটি বিক্রিসহ অবৈধ সব কিছু চলছে। অকার্যকর প্রশাসনিক উত্তরণের জন্য আমরা বাংলাদেশে নির্বাচন চাই। এই ক্ষেত্রে শুধু মেলার কথা বললে লাভ হবেনা, সবকিছুর কথা বলতে হবে। প্রশাসন ডিসি, এসপি সবাই কারো কথা শুনছেন না। তাদের উচ্ছেমত সব কিছু করছে, দেশ চালাচ্ছে। শুধু বানিজ্য মেলার জুয়া না, আমরা সব কিছুর অবসান চাই।
কুমিল্লা মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব মুদাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, মেলার বাহিরে টিকেট বিক্র করা দুঃখ জনক। আমি নিজেও একাধিকবার ২২নং ওয়ার্ডের কচুয়া চৌমুহানী, দৈয়ারা, লক্ষ্মীপুর ও দুর্গপুর এলাকায় বেশ কয়েকজন বিক্রেতাকে বিতাড়িত করেছি। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে নিম¥ আয়ের মানুষ তাদের ৬০-৭০ শতাংশ আয় দিয়ে প্রতিদিন র‌্যাফল ড্র-এর কুপন কনিছেন। এতে তিনি একদিকে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অপরদিকে পরিবারের ভরণপোষণ যোগাতেও হিমসিম খাচ্ছেন। প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন আইনতো প্রণয়ন করা আছে, আপনারা প্রয়োগ করছেননা কেন?। চাঁদের আলোর মতো সত্য কুমিল্লাজুড়ে টিকেট বিক্রি হচ্ছে। অনুরোধ থাকবে আপনারা আইনের প্রয়োগ করুন এবং মেলার বাহিরে র‌্যাফল ড্র-এর টিকেট বিক্রি বন্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
এ বিষয়ে জানতে র‌্যাফল ড্র-এর দায়িত্বে থাকা মাহাবুবকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন বলেন, মেলার বাহিরে লাটারির নামে টিকে যদি বিক্রি হয় অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। বিষয়টি আমার জানা নেই, আপনার মাধ্যমে শুনেছি। খোঁজ-খবর নিচ্ছি, সত্যিহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, প্রথমত মেলার অনুমতি আমাদের থেকে নেয়া হয়নি। এছাড়া র‌্যাফল ড্র-এর নামে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে যে টিকেট বিক্রি হচ্ছে এ স¤পর্কে আমি অবগত রেয়েছি। তবে এটা অনাকাঙ্খিত, অন্যায্য এবং অন্যায়। কোন ভুক্তভোগী যদি লিখিত অভিযোগ দেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।