বেনাপোল বন্দরে লাইভ করতে গিয়ে ….শাহাজাদা এমরান

সময়ের কলাম
.শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

এপেক্স বাংলাদেশের জেলা ৬ এর সম্মেলনে যোগদানের জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে হোটেল নূর জাহান থেকে যশোরের বাসে উঠি। বাস ছাড়ার কথা ছিল রাত ১১টায় কিন্তু ২ ঘন্টা সিস্টেম লস করে ছাড়ে রাত ১টায়। সাথে ছিলেন এপেক্সিয়ান ওয়ালিউল্লাহ রিপন ও দৈনিক মানবকন্ঠের কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি তারিকুল ইসলাম তরুণ। আল্লাহর রহমতে ২৫ ডিসেম্বর বুধবার সকাল ৭টায় যশোর শহরে পৌঁছি। জয়তী সোসাইটির রেস্ট হাউস আমাদের জন্য আগেই বুকিং করা ছিল। তাই জয়তীতে গিয়ে ঘন্টা দুই বিশ্রাম করে আমরা যশোর পৌরসভার কনভেনশন হলে যাই, যেখানে আমাদের জেলা ৬ সম্মেলনের ভ্যানু।
যশোর জেলা প্রশাসক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার সাথে সাথে সাংবাদিক তরুণকে বললাম চল, কোথায় থেকে ঘুরে আসি। প্রথমে মহাকবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও দূরুত্বের কারণে সেটা বাদ দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্থল বন্দর বেনাপোল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। যশোর শহর থেকে প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের বাস জার্নি ও পরবর্তীতে ২০ মিনিটের অটো জার্নি শেষ করে আমরা পৌঁছে যাই বেনাপোল স্থল বন্দর। এখানে একটি কথা বলে রাখি, এবার বাকীন ভাই আমেরিকা থেকে আসার সময় আমার জন্য সোনালী ফ্রেমের একটি চশমা নিয়ে আসেন। বেনাপোলগামী বাসটি যখন ঝিকরগাছা আসে তখন আমি বাসের জানালার কাছে বসেছিলাম। আর আমার প্রিয় চশমাটি কি মনে করে চোখ থেকে খুলে মাথায় দিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ঘুমের কারণে আর বাসের ঝাক্কির কারণে আমার প্রিয় সোনালী কালারের চশমাটি মাথা থেকে পড়ে যায় । লক্ষ করলাম সাথে সাথে অপর একটি চলন্ত বাস চশমাটি পিশে চলে যায়। দৃশ্যটি দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
যাইহোক, এই স্থল বন্দর ব্যবহার করেই ২০০২ সালে আমি প্রথম বারের মতো ভারত গিয়েছিলাম টিম আমোদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধেয় বাকীন (বাকীন রাব্বী) ভাইয়ের নেতৃত্বে। কিছুক্ষণ হেঁটে লক্ষ করলাম আগের চেয়ে বন্দরটি উন্নত হয়েছে যৎ সামান্যই। বন্দরের মূল গেইটে বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে, যা আগে ছিল না। বিষয়টি আমার খুব ভালো লেগেছে। এখানে ছবি উঠালাম আমরা দুই জন।
আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক। সুতরাং সাংবাদিকতার ৩১ বছরে যখন যেখানেই গিয়েছি সেখানেই চেষ্টা করেছি সাথে সাংবাদিকতাকে রাখার জন্য। এমনকি ২০০২ সালে যখন ভারতের কলকাতা গিয়েছি তখনো তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভার চীফ হুইপের সাক্ষাতকার নেওয়ার আমার সুযোগ হয়েছিল। যা দৈনিক দিলকাল ও সাপ্তাহিক আমোদ এ প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। তো,তরুণকে বললাম, চল কুমিল্লার জমিন এ একটা লাইভ দেই। সাথে সাথে লাইভটি অন করে যখন ৪ মিনিট হলো ঠিক তখনি বিজিবির এক কর্মকর্তা এসে পরিচয় জেনে বলল, ভাই সিসিটিভিতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখছে, প্লিজ অফ করে দেন। আমি লাইভটি অফ না করে তাদের সাথে হ্যান্ডশ্যাক করে লাইভটি নিয়েই মূল গেইটের বাহিরে চলে এসে লাইভটি অফ করে দিলাম। যখন দেখলাম অল্প সময়ে অনেক ভিউ হয়েছে তখন তরুণকে বললাম চল , বেনাপোল বন্দরের কাজ করা মানুষদের জীবন মান নিয়ে আরেকটা লাইভ দিয়ে চলে যাই। সাংবাদিক তরুণ রাজি হলে, আমি পূনরায় দ্বিতীয় বারের মতো গেইটের বাহিরে যেখানে গাড়ি স্ট্যান্ড এবং বিভিন্ন হকাররা পসরা সাজিয়ে বসেছে এবং অসংখ্য মানুষের কোলাহল সেখানে লাইভ দেই।
বেনাপোল বন্দরে দ্বিতীয় লাইভটি শুরু করার পরই বিভিন্ন অটো রিক্সা,রিক্সা ও প্রাইভেট কারের চালকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল বক্তব্য দেয়ার জন্য। তাদের একটাই কথা, ভাই ভারতকে বলেন ভিসা দেওয়ার জন্য। ভারত বাংলাদেশীদের ভিসা না দেওয়ার কারনে গত কয়েক মাস ধরে শতকরা ৮০ ভাগ এপার ওপারের ( বেনাপোল- পেট্রাপোল) দরিদ্র মানুষদের আয় রোজগার কমে গেছে। এরপর বক্তব্য নিলাম ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সের এক ডাব বিক্রেতার । সে জানাল একই কথা। লক্ষ করলাম বেশ কিছু নেতাগোছের লোক বক্তব্য দিতে চায় না কিন্তু আমাদের লক্ষ করছে। ডাব বিক্রেতাকে বললাম,এখন আপনাদের কোন চাঁদা দিতে হয়নি। সে আমতা আমতা করে জানাল, না,চাঁদা দিতে হয় না। ডাব বিক্রেতার এ কথা শুনে উপস্থিত বেশ কয়েকজন ফেরিওয়ালা সমস্বরে বলে উঠল, স্যার সে ভয়ে মিথ্যা বলছে। চাঁদা আমরা আগেও দিয়েছি, এখনো দেই। ৫ আগস্টের পর ব্যক্তির বদল হয়েছে কিন্তু চাঁদা দেওয়া কমে নাই। চাঁদা নিয়ে কথা বলার সাথে সাথেই এতক্ষণ ধরে যারা আমাকে ফলো করছে তাদের একজন জ্যাকেট পরিহিত হ্যান্ডসাম যুবক সামনে এসে বলল, ভাই আপনার পরিচয়,কেন লাইভ করছেন। আমি বললাম, লাইভ শেষে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব।এ কথা বলে আমি সামনে এগিয়ে লাইভ কনটিনিউ করতে লাগলাম। আর তরুন ঐ লোকের সাথে তর্ক করতেছে। এরই মধ্যে এক মধ্য বয়সের মহিলা সামনে পড়ল। তার পেছনে অনেক ভারতীয় কম্বল। স্থানীয় ভাষায় তারা বলে ব্ল্যাকিং কম্বল যা অবৈধ ভাবে ভারত থেকে নিয়ে এসে বিক্রি করে। মহিলাকে বললাম, কোথায় যান। বলল, চিকিৎসা করাতে। সাথে কে, স্পস্ট উত্তর,কেউ নেই। লাইভে কম্বলগুলোও দেখা যাচ্ছে। এবার হঠাৎ করেই কে যেন বলে উঠল এই কম্বল এখান থেকে নিয়ে যায়। ক্যামেরায় কিন্তু উঠে গেছে। খবরটা চলে গেল সাংবাদিক তরুণ যার সাথে তর্ক করছে তার সাথে। আমি পরিস্থিতি বুঝে লাইভটি বন্ধ করে তরুণকে ইশারা দিচ্ছি চলে আসার জন্য। কিন্তু তরুণ সেখানে আমাকে হাই লাইট করে জোড়ে জোড়ে কথা বলতেই আছে।
আমি তাই ঐখানে গেলাম। গিয়ে ঐ ভদ্রলোককে বললাম, এবার আপনি আমাকে বলেন, আপনি কি জানতে চান। বলল,আপনি এখানে লাইভ করলেন কেন , কে আপনি, কি পরিচয়। আমি বললাম,আমি কে এটা আপনার জানার খুব দরকার নেই। আমি একজন সাংবাদিক। এটাই আমার বড় পরিচয়। এবার বলল, আপনার সাংবাদিকের আইডি কার্ড কোথায়,লাইভ যে করলেন বোম কোথায়। এখানে যত সাংবাদিক লাইভ করতে আসে বোম নিয়ে আসে,আমাদের ফোন করে আসে। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেই। আমি বললাম আপনি কে ? তিনি বললেন আমি বিএনপি করি। তখন আমি বললাম আমি দৈানিক দিনকালের স্টাফ রিপোর্টার। তখন তিনি বললেন, আমাদের বেনাপোল সাংবাদিককে চিনেন। আমি জানালাম না, তাকে চিনা তো আমার জরুরি না। তিনি বললেন, বোম ছাড়া অনেকে আসে। এসে আমাদের দলের দূর্নাম করার জন্য ফালতু নিউজ করে তারা সাংবাদিক না। আপনি যে সাংবাদিক তার পরিচয় কি। তখন আমি পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে বললাম, এই আমার পরিচয়। তিনি বললেন আইডি কার্ড। আমি বললাম, জনাব তারেক রহমান দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। আর জনাব শিমুল বিশ^াস ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। আপনার বেশি প্রয়োজন হলে আপনি তাদের ফোন করে আমার পরিচয় জেনে নেন। আর আমি যদি আপনাকে প্রশ্ন করি আপনি যে বিএনপি করেন তার প্রমান কি আপনার কাছে কি কোন আইডি কার্ড আছে,আপনি দেখাতে পাররেন ? আমার এ কথা বলার পর এবার ঐ লোক গলার স্বর কিছুটা নরম করে একজনকে দেখিয়ে বললেন, উনাকে চিনেন, উনি এই এলাকার নাম করা সাংবাদিক। আমি তখন ঐ সাংবাদিককে বললাম, ভাই আপনার পত্রিকার নাম কি। সাংবাদিক সাহেব খুবই নরম গলাম বললেন দৈনিক স্পন্দন। তখন আমি বললাম, আপনার এই পত্রিকা দিয়ে হবে না। দেশের যেকোন মূল ধারার পত্রিকা কিংবা টিভির আপনার এলাকার যারা সাংবাদিক আছে তাদের মাধ্যমে কুমিল্লার যে কোন সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন আমি কে ? এরমধ্যে একজন লোক আমার ছবি তুলে তিনি তার ক্যমেরা থেকে একটি ছবি বের করে বললেন, দেখেন তো ভাই উনি কুমিল্লার একজন বড় সাংবাদিক। উনাকে চেনেন কি না। আমি বললাম, আমি উনাকে চিনি না আর আমার তাকে চেনার দরকারও নেই। আপনি তাকে বলেন, সে আমাকে চিনে কি না বা নাম জানে কি না। সে যদি আমাকে না চিনে বা আমার নাম না জানে তাহলে সে ভালো খারাপ, হলুদ কিংবা লাল কোন ধরনেই সাংবাদিকের জাতই না। ইচ্ছে করেই একটু গলার স্বর উচ্চ করে এ সময় কথা বললাম।
ইতিমধ্যে আমাদের ঘিরে শতাধিক মানুষের জটলা হয়ে গেছে। এর মধ্যে ফোন করে একজন নেতাকে আনা হলো। নেতা এসেই বললেন, কে চাঁদাবাজি বা কম্বলের লাইভ করেছে। তখন কয়েকজন আমাকে দেখিয়ে বললেন উনি। তখন তিনি আমাকে বললেন, আপনার কাছে আইডি কার্ড আছে। বললাম না।ভিজিটিং কার্ড আছে বলেই তাকে দিলাম। তিনি পুরো ভিজিটিং কার্ড পড়লেন। পড়ে বললেন, ভাই সব ঠিক আছে। আমরা স্থানীয় রাজনীতি করি। আপনার ঐ চাঁদাবাজির কথা বা কম্বল দেখালে আমাদের সমস্যা হবে। এগুলো আপনি ডিলেট করে দেন। আমি বললাম আপনার পরিচয় কি ।তখন তিনি বললেন, আমার পরিচয় আপনার জানার দরকার নেই, আগে ভিডিও ডিলেট করেন। আমি বললাম, প্রশ্নই আসে না। আমার লাইভ আমি ডিলেট করব কেন ? তখন তিনি ছো মেরে মোবাইলটা টান দিয়ে একজনকে দিয়ে বলল,দ্রুত লাইভ দুটি ডিলেট কর। সে ডিলেট করার পর ঐ নেতা আমার হাতে মোবাইলটি দিয়ে বলল,সরি ভাই । দিনকাল আমাদের পত্রিকা, আপনি সাংবাদিক। সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যদি এখানে লাইভ করার আগে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলতেন, তাহলে তারা আপনাকে কিভাবে কথা বলবেন এটা বুঝিয়ে বলত,আপনিও ভালো সম্মান পেতেন। কিছু খাবেন। তখন সাংবাদিক তরুন বলল, আপনারা আমাদের ভিডিও ডিলেট করলেন, আবার এখন খেতে বলেন। এরপর আমি ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসি।
এরপর ২৫ মিনিট পর কুমিল্লা থেকে একের পর এক বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে বলল, ভাই কি হয়েছে। ছোট করে বললাম, এই। এরপর শুরু হলো সামাজিক মাধ্যমে আমাকে হেয় করার জন্য একের পর এক কল্প কাহিনী বলে নিন্দা জানানো। যাদের বেশীর ভাগই আমার অনেক অনেক জুনিয়র। যাদের সাথে আমার কথা তো খুব একটা হয় ন,া এমনকি দেখাও হয় কালে ভাদ্রে। এমন একজন ছেলে এমন একটি আপত্তিকর পোস্ট করেছে যার সাথে পরিচয় না থাকার পরেও ২০২৩ সালে যাকে আমি পিআইবির আবাসিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। তখন সে যে আমার কি প্রশংসা করেছিল , তা মনে হলে এখনো লজ্জা লাগে।
আমার কিছু সিনিয়র সহকর্মী কয়েকটি স্থানে মন্তব্য করেছে আমাকে ফোন না করে। অথচ দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে তাদের সাথে আমার পথচলা। বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় এক জুনিয়র সাংবাদিক ফোন করে আমাকে বলেছে, ভাই আপনার কি হয়েছে আমাকে …. এক ভাই বলল, শাহাজাদা ভাইয়ের উপর বেনাপোলে হামলা হয়েছে , ফেসবুকে নিন্দা জানাও। আমি তাকে বললাম, তোমার ভাইকে বল,শাহাজাদা ভাইয়ের প্রতি দরদ দেখিয়ে আপনি যে আমাকে স্ট্যাটাস দিতে বললেন, আপনি উনাকে ফোন দিয়েছেন নি। তোমার ভাইয়ের উত্তর যদি ইতিবাচক হয় তাহলে তুমি স্ট্যাটাস দাও, আর যদি নেতিবাচক হয় তাহলে তোমার বিবেক খাঁটিয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নাও।
কুমিল্লার এক শ্রেণীর সাংবাদিকদের আমার প্রতি কথিত দরদ দেখে সাংবাদিক তরুণ চোখের পানি ফেলে দিয়ে বলল, ভাই,তারা যেভাবে মিথ্যা বানোয়াট গল্প বানিয়ে প্রচার করছে আমি যদি আপনার সাথে না থাকতাম তাহলে আপনি বললেও বিশ^াস করতাম না। মনে মনে হলেও বলতাম,কিছু হলেও হয়েছে। কিন্তু আপনি যেভাবে বিষয়টি ট্যাকল দিলেন,তাদের সাথে কথা বললেন এর বিপরীতে তারা যে নোংরামী করছে আপনি কাউকে কিছু বলছেন না কেন। বিপরীতে আমি তরুণকে সান্ত্বনা
দিয়ে বললাম, সম্মান আর অসম্মান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আমি উপরওয়ালার কাছেই ছেড়ে দিলাম। মহান আল্লাহ সবাইকে নিজ বিবেক সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝে চলার তওফিক দান করুক-এই দোয়া রইলো ।

লেখক : সম্পাদক , দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও দৈনিক কুমিল্লার জমিন, স্টাফ রিপোর্টার,দৈনিক দিনকাল।