‘কুমিল্লা মুক্ত দিবস ও একাত্তরের চেতনা’ বিষয়ক টক শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাতে কুমিল্লা আল নূর হসপিটাল, মিশন হাসপাতাল প্রা. লি. ও কুমিল্লা হরমোন সেন্টার ও জেনারেল হাসপাতালের সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে ১৫৭ তম পর্বের এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় টকশো তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার জহিরুল হক দুলাল ও কুমিল্লা যুবদল ও ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও বিএনপি নেতা ড. শাহ মো. সেলিম।
এসময় টক শো তে, কুমিল্লা মুক্ত দিবস ও একাত্তরের চোদনার পাশাপাশি সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠেছে৷
আলোচনা এক পর্যায়ে, জহিরুল হক দুলাল বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটা জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমাদের তরুণ সমাজ অংশ নিয়েছিলো। পুরা জাতি তখন একত্রিত হয়ে গিয়েছিলো। অনেকে আত্মরক্ষার জন্য ভারতে চলে গিয়েছিলো শরণার্থী হিসেবে। আমরা যারা যুদ্ধে অংশ নিই, ভারতের সহযোগীতায় আমাদেরকে সেই যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিলো। যুদ্ধ প্রথমে এক পক্ষের ছিলেও পরে কিন্তু এই যুদ্ধ উভয় পক্ষের শুরু হয়। তুমূল যুদ্ধ শুরু হয় মূলত নভেম্বরের দিকে৷ তখন ভারতীয় সেনারা অংশ নিয়েছিলো যুদ্ধে। তখন থেকেই পাকিস্তানীরা পিছু হটতে থাকে। কুমিল্লা স্বাধীন হওয়ার আগে অনেক জেলাই স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। ভারত আমাদের সহযোগীতা করলেও, আমি বলবো আমাদের নিজেদেরই যুদ্ধ শেষ করা উচিৎ ছিলো। তখন হয়তো সময় বেশী লাগতো, কিন্তু ভারত তাহলে এটা বলতে পারতো না যে পাকিস্তানীরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যৌথ বাহিনী তৈরী হয়েছিলো তখন। ভারতীয় বাহিনী এককভাবে যুদ্ধ করে নি। সব জায়গাতেই ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো। কিন্তু, আত্মসমর্পণের সময় আমাদের কর্ণেল ওসমান গণী না থাকায় এটা অনেকে ভাবছেন ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এটা সঠিক নয়। তাই বলেছি, স্বাধীন হতে সময় লাগলেও আমাদের উচিৎ ছিলো নিজেদের যুদ্ধ নিজেরা শেষ করা। পাকিস্তানীরা ইতিমধ্যেই পরাজিত হওয়ার পথে ছিলো৷ আমাদের জয় নিশ্চিত ছিলো। হয়তো আমাদের রক্তক্ষয় বেশী হতো তখন। কিন্তু, আমার ধারণা, ভারত তড়িঘড়ি করেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো।
এই কারণেই ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তারা নভেম্বর মাসের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। ভারত এখানে নিজের মতো করে যুদ্ধ শেষ করতে ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা না হতে দিতেও তারা এই কাজ করেছিলো। আগে এই কুমিল্লা মুক্ত দিবস উপলক্ষে ৮-১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লা টাউনহলে বই মেলা হতো। কিন্তু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এই বই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। সময় তার নিজস্ব গতিতে চলে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই পালটে যায়। আমার বয়স বেড়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে, রাজনৈতিক চেতনা পাল্টেছে। আমার ধারণা, একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য আমাদের যে যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন সেটা নেই। আমরা নিজেরাই তো ঠিক নেই। তাহলে আমাদের সাথে কেন ঠিকটা হবে। ২৪ এর ৫ ই আগষ্ট যেটি হয়েছিলো সেটি হয়েছিলো বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের কারণে হয়েছিলো। ১৬ ডিসেম্বর ও ৫ই আগষ্টের চেতনাকে এক করা যাবে না৷ দুটোর উদ্দেশ্য এক নয়৷ একটি ছিলো স্বৈরাচার সরকারের পতন ও অন্যটি হলো দেশের স্বাধীনতা নিয়ে আসা। আর, ভারত নিজেই তো সাম্প্রদায়িক, তারা বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক কিভাবে বলতে পারে। তারা এসব করে কোনো সুবিধা করতে পারবে না। তারা সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণেই তাদের আচরণে সাম্প্রদায়িকতা ফুটে উঠেছে
ড. শাহ মো. সেলিম বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর ছিলাম। আমি ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী৷ ৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। তখন ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা ইপিআর ক্যাম্প ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়৷ পরে ৮ ডিসেম্বর তারা কুমিল্লা ছেড়ে যায়। দ্বিধা নেই বলতে, আজ অনেকে একাত্তরের চেতনাকে ম্লান করতে চাচ্ছে, আমি বলবো সেই একাত্তরের সময়কালে আমরা দেখেছিলাম কি হয়েছিলো। ৮ ই ডিসেম্বর যখন কুমিল্লা মুক্ত হয় তখন আমি আমার কালিরবাজারের বাড়িতেই ছিলাম।
এর আগে ৪ তারিখে কালির বাজারে প্রথম মর্টারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। আমার বাবা তৎকালীন আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমার বাবাকে এপ্রিলের দিকে পাক আর্মীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। আমি ৮ তারিখ বিকালে কুমিল্লা শহরের দিকে এসে দেখি সবাই হই হই রই রই করে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছিলো। এইবারের ১৬ ডিসেম্বরে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার একটি দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা হলো ‘বিজয় মেলা’। আমরা ৯১ সালে প্রথম এই কুমিল্লায় বিজয় মেলার আয়োজন করি। তখন আমরা বইমেলার পাশাপাশি আলোচনা সভাও করা হতো। কিন্তু, আওয়ামীলীগ সরকার আসার পর সেটা আর দেখা যায় নি। ২৬ তারিখ স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছে আর মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিলো ১৭ এপ্রিল। মাঝখানের এই দিনগুলোতে যুদ্ধ কে পরিচালনা করেছিলো।
শহীদ জিয়াউর রহমান তখন সম্মুখ সারিতে থেকে তা পরিচালনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যতদিন জীবিত ছিলেন, তিনি একবারের জন্যও মেহেরপুর যান নি। এই মেহেরপুরেই তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, অথচ সেই নেতাদের স্মরণে তিনি কখনোই মেহেরপুর যান নি। হয়তো অহংকার থেকেই তিনি এই কাজ করেছেন। একটা পক্ষ বাংলাদেশকে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করার কারণে তাদের পরিণতি সবাই দেখতে পাচ্ছে। যে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সে জিয়াউর রহমানকে কিভাবে পাকিস্তানের পক্ষের লোক বলতে পারেন? ১৯৭১ সালকে বাদ দিয়ে আপনি কখনো বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে পারবেন না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা একপাক্ষিক করতে চেয়েছিলো তাদের এখন করুণ পরিণতি। এই কারণে ৫ই আগষ্টের ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবার। এটা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের সবাইকে ধারণ করতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশী। তাহলে, আর সংখ্যালঘু শব্দকে পুঁজি করে আমাদের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারবে না।