‘ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হানাদারদের মোকাবেলা করেছি ’

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প- ৩৫
শাহাজাদা এমরান ।
প্রকাশ: ১০ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু : বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুস সামাদ বলেছেন, আমি তখন বুড়িচং উপজেলার ভরাসার হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি।১৯৭১ সালের ২৭মার্চ সকালে হঠাৎ করে কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা আমাদের স্কুলে এসে শিক্ষকদের কাছে জানতে চান, এখানে কে কে হিন্দু শিক্ষক রয়েছেন। এ কথা শুনে একই ক্লাশে পড়া আমার বন্ধু হরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথকে সাথে নিয়ে ভয়ে দিলাম এক দৌঁড়। পরে রাস্তায় বই ফেলে সোজা চলে আসি হাতিমারা ক্যাম্পে। সীমান্ত এলাকায় বাড়ি ছিল বলে সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকাগুলো ছিল আমার খুব পরিচিত।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু : হাতিমারা গিয়ে দেখি অধ্যক্ষ আফজল খান, আমার তালুই সোলেয়মান,আবদুল মতিনসহ আরো অনেকে রয়েছেন। আমার তালুই সোলেয়মান কমান্ডার জানতে চান কেন আমি হাতিমারা এসেছি। আমি যুদ্ধ করার কথা জানালে আফজল খানের অনুমতি নিয়ে ঐ দিনই আমাকে ক্যাম্পে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথম অবস্থায় অস্ত্রের সংকটও ছিল। আমরা জঙ্গেলের বাঁশ কেটে অস্ত্র বানিয়ে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষন নেই। এখানে আমরা প্রায় ২১ দিন প্রশিক্ষন নেই। আমাদের প্রশিক্ষন কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল আবদুল ওহাব এবং ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট। এই প্রশিক্ষন কেন্দ্রে প্রথমে আবদুল হাকিম,আবদুল মালেক,আবদুল হালিম,নুরু মিয়া এবং সফিকসহ আমরা প্রায় ৮/১০ জন প্রশিক্ষন নেই। পরে এপ্রিলের ১৫ তারিখের দিকে আমরা হাতিমারা থেকে মেলাঘর যাই। এখানে আমরা তিন মাসের আরেকটি প্রশিক্ষন গ্রহন করি। এখানেও প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লে.কর্নেল আবদুল ওহাব।আমি থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনার প্রশিক্ষন নেই।

যুদ্ধের অণুগল্প : বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুস সামাদের কাছে যুদ্ধের অণুগল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, জঙ্গল কেটে,পাহার কেটে ক্যাম্প প্রতিষ্টা করেছি। যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহুর্ত মনে হয়েছে এই বুঝি শক্রুর বুলেট এসে আমার জীবন নিয়ে গেল। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হানাদারদের মোকাবেলা করেছি কিন্তু কখনো পিছপা হইনি। যুদ্ধ ক্ষেত্র যে কি জিনিস একমাত্র তারাই ভাল জানবেন, যারা নিয়োজিত ছিলেন। খাবার সংকট,বিশুদ্ধ পানির সংকটও ছিল নিত্য সঙ্গী ।

জুন মাসের ২০ তারিখ সোলেমান কমান্ডারের নেতৃত্বে আমাদের ১১৪জনকে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার রাজাপুর পাঠানো হয় যুদ্ধ করতে। এটাই ছিল আমার প্রথম যুদ্ধ। এখানে আমাদের দায়িত্ব ছিল চলন্ত হানাদার বাহিনীর গাড়ি ও নৌকাকে আক্রমন করা। এই যুদ্ধে পাকিস্থানী সুবেদারসহ ৫জন নিহত হয়। আর আমাদের কৌশল ছিল ছোট ছোট আক্রমন করে তাদের সার্বক্ষনিক ব্যতিব্যস্ত রাখা। জুলাই মাসের শুরুতে আমাদের পাঠানো হয় আমাদের এলাকা আমড়াতলী ক্যাম্পে। আমরা এখানে এসেই একটি যুদ্ধের সম্মুখীন হই। সকালের দিকে আমাদের ক্যাম্পে খবর এলো,রসুলপুর থেকে একদল পাঞ্জাবী আমরাতলী গ্রামে আসতেছে। আমরা খবরটি শুনেই প্রস্ততি নিয়ে নেই। কিন্ত আমাদের দূর্ভাগ্য হলো, স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাঞ্জাবীরা আমাদের অবস্থান আগেই জেনে যায়। ফলে তারা গ্রামে উঠেই এলোপাতারী ফায়ার শুরু করে। তাদের এমন আক্রমনের জন্য আমরা প্রস্তুতি ছিলাম না। যার কারণে আমরা ৩০ মিনিট পর্যন্ত কমান্ডারের নির্দেশে ফায়ার ওপেন করিনি। ৩০ মিনিট পর আমরাও পাল্টা আক্রমন শুরু করি। এই যুদ্ধে আমরা হারাই আমাদের শিমরার সফিককে। আর আমাদের বেশ কয়েকজন সাথী আহত হয়। এর মধ্যে আমি,যশপুরের আলী আহাম্মদ, বদরপুরের আবদুস সালাম প্রমুখ। আমার হাতে এবং পায়ে গুলি লাগে। পরে আমাকে রক্তাত্ব অবস্থায় সোনামুরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে ৪দিন চিকিৎসা নেয়ার পর আমি কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আবার যুদ্ধের মাঠে ফিরে যাই। এর পর কোটবাড়িতে একটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ার পর আমাদের গ্রুপের সবাইকে মেলাঘরে পাঠানো হয় । যেহেতু আমি যুদ্ধাহত সেহেতু আমাকে বলা হলো, তুমি এখন থেকে মেলাঘর ক্যাম্পেই কাজ করবে। সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই। পরে কুমিল¬া মুক্তদিবস পর্যন্ত দীর্ঘ দুই মাস আমি মেলাঘরে কাজ করি। ৮ ডিসেম্বর যখন কুমিল¬া মুক্ত হয় তখন আমরা ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে ছিলাম। খবরটি শুনার পর আমরা যারা কুমিল¬ার মানুষ ছিলাম তারা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে উল¬াস করতে করতে কান্না করে দিয়েছি । ৯ ডিসেম্বর আমরা কুমিল¬া চলে আসলে আমাদের আবার বানাশুয়া ক্যাম্পে পাঠানো হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা বানাশুয়া ক্যাম্পে ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে কুমিল¬া ময়নামতি সেনানিবাস গিয়ে অস্ত্র জমা দিলে একটি সনদ,নগদ ৫০০টাকা একটি কম্বল দিয়ে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ।

পরিচয় : মো. আবদুস সামাদ।পিতা মৃত আবদুল হক ও মাতা জয়নাব বিবি। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় । কুমিল¬ার আদর্শ সদর উপজেলার ৪নং আমড়াতলী ইউনিয়নের শিমরা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন তিনি।