‘শরণার্থীদের যুদ্ধজীবন : ১৯৭১ ’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ

শামছুল আলম রাজন ।।
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

“শরণার্থীদের যুদ্ধজীবন : ১৯৭১” বইটি লিখেছেন শাহাজাদা এমরান। তিনি একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। এটি তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তৃতীয় বই। ২০১৪ সালে তার প্রথম বই “রণাঙ্গনের বীর” ও ১৬ সালে “বীরঙ্গণার কথা” নামে দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়। তার লেখা সবগুলো বই বাঙালি জাতির জীবনের এক অনন্য গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। লেখক তার প্রতিটি বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের একেকটি দিক বিশদ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। পাঠকদের কাছে বইগুলো ইতিমধ্যে ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় শরণার্থীদের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। শরণার্থীদের ত্যাগ তিতিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা, বই প্রকাশ বা লেখালেখি তেমন চোখে পড়ে না। অথচ শরণার্থীদের সংখ্যা চমকে উঠার মত। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ ভাগই শরণার্থী হয়েছিলেন। তাই লেখক শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উপলব্দি করতে পেরেছেন শরণার্থীদের উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিষয়টি তিনি তার বইয়ের ভুমিকায় উল্লেখ করেছেন। ভুমিকায় আরো উল্লেখ করেছেন কিভাবে শরণার্থীরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মানবিক সমর্থন যুগিয়েছিল।

শরণার্থীরা হয়ত অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু যুদ্ধের প্রতিটি আঘাত তাঁরা সহ্য করেছেন। অনেকে সে আঘাত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। এ বিষয়গুলো লেখক তার লেখনিতে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন। এসব তথ্য তুলে আনতে ৭১ এর শরণার্থীদের খোঁজে লেখক চষে বেড়িয়েছেন পাহাড় থেকে সমতলে। বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি তিনি গিয়েছেন উত্তর-পশ্চিমাআঞ্চলেও। মোট ৬১ জন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং বইয়ে তাদের সংগ্রামী জীবনের কথা চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন।

৬১ জনের মধ্যে আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে যশোর জেলার মনিরাম উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের সোনালী ভট্রাচার্যের শরণার্থী হওয়ার স্মৃতিচারণ। প্রাণ ভয়ে ভারতে যাওয়ার পথে তিনি ও তার ভাই তাদের মা-বাবাকে হারিয়ে ফেলেন। পথে একপর্যায়ে রাজাকার ও পাকিস্তান আর্মির কাছে ধরা পড়েন। কয়েকশ মানুষের সাথে তাদেরকে চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করানো হয়। প্রায় ২০/৩০ জনকে গুলি করে হত্যার পর পাকিস্তান আর্মিদের গুলি শেষ হয়ে যায়। পরে অন্যদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রানে বেঁচে যায় সোনালী ভট্রাচার্য ও তার ভাই। সোনালী ভট্রাচার্য পরে আবার কিভাবে তার মা বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলেন সে কথাও লেখক বিস্তারিত ভাবে বর্ননা করেছেন। বইটি পড়ে এ ধরনের অনেক হৃদয় বিদারক ও করুণ পরিস্থিতির কথা উপলব্ধি করতে পেরেছি।

গ্রন্থ লেখকের সাথে কলাম লেখক শামছুল আলম রাজন

লেখক শাহাজাদা এমরান আরেক শরণার্থী জয়গুন নেছার কথা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেন, এটি তার শোনা সবচেয়ে নির্মম ঘটনা। তিনি তার সাংবাদিকতার তিন দশকে এমন নির্মম ঘটনা শুনেন নি। আমার কাছেও শরণার্থী জয়গুন নেছা শরণার্থী হওয়ার ঘটনা অনেক হৃদয়বিদারক মনে হয়েছে। জয়গুন নেছা একজন বিরঙ্গনা সেই সাথে শরণার্থী। ১৯৭১ সালে জয়গুন নেছার নির্মম সময়গুলো বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন বইটিতে। জয়গুন নেছার বর্ননা পড়ে আমার মত যে কোন পাঠকের চোখে পানি চলে আসতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ সময়ের কালো ছায়া আর অপবাদ এখনো জয়গুন নেছাকে তাড়া করে ফিরছে।

এছাড়া কুমিল্লার শরণার্থী শান্তি রঞ্জন দাশের বর্ননা পড়ে উপলব্দি করতে পেরেছিলাম বাংলাদেশের শরণার্থীরা কিভাবে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাস্ট্র ভারতকে একটি বিশেষ বিমান দিয়েছিল শুধু শরণার্থীদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নেওয়ার জন্য। শান্তি রঞ্জন দাশ ভারতের সিংরাইস বিমান বন্দর থেকে সেই মার্কিন বিমানে করে আসামের গৌহাটি শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সে ক্যাম্পে প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশী শরণার্থী ছিল।

শরণার্থীদের বর্ননা থেকে লেখক বইয়ে লিখেন প্রতিটি ক্যাম্পে ছিল সুপেয় পানির ভীষণ অভাব। সেই সাথে ছিল তীব্র জ্বালানি সঙ্কট। ডায়রিয়া সহ বিভিন্ন রোগে শোকে ক্যাম্পে প্রান হারিয়েছেন শত শত মানুষ। স্বজন হারানোর আহাজারি ক্যাম্পে লেগেই থাকতো।

কেউ কেউ শরণার্থী হয়েও মুক্তিযুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে কথাও অনেকের বর্ননায় উঠে এসেছে। কেউ রেড ক্রসের স্বেচ্ছাসেবী হয়ে, কেউ বা টেকনিশিয়ান হয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে মানুষের সেবা করেছেন। কেউ ক্যাম্পে নিয়মিত পত্রিকা বিলি করে মুক্তিযুদ্ধের খবর জানিয়েছিলেন।

আবার কেউ কেউ দেশে স্বচ্ছল ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাণ ভয়ে ভিটা মাটি সব ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী দেশে ফিরে দেখেন সব তছনছ হয়ে গেছে। অনেকে নিজের বাড়িঘরও চিনতে পারেননি। অনেক পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এখনো।

লেখক চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীরা কত গভীর ভাবে জড়িত ছিল। তাই শরণার্থীদের রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদানের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন লেখক।

বইয়ে উল্লেখিত ৬১ জন শরণার্থী সবাই রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবী জানিয়েছেন। দুঃখের বিষয় ৬১ জন শরণার্থীর মাঝে ৩ জন শরণার্থী এখন আর আমাদের মাঝে নেই। এ সংখ্যা আরো বাড়ার আগেই শরণার্থীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সকল শরণার্থী ও লেখকের সাথে আমারও এই দাবি।

সর্বপরি বলবো, “শরণার্থীদের যুদ্ধজীবন : ১৯৭১” বইটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে শত শত বছর থাকবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম বইটি পড়ে জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের ত্যাগ ও অবদানের কথা। সকলের বইটি পড়া উচিৎ।

লেখক :
সম্পাদক, কুমিল্লার বার্তা ডটকম।
০১৭১১৭১১৩৭৬