কুমিল্লায় নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে

সোহাইবুল ইসলাম সোহাগ
প্রকাশ: ১২ মাস আগে

নাম চৈতী জাহান। সে কুমিল্লার সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। একই কলেজের সহপাঠী নাদিরার সাথে হয় বন্ধুত্ব। ধীরে তারা অনেক ক্লোজ বান্ধবী হিসেবে সম্পর্কটি তাদের আরও বৃদ্ধি পায়। চৈতীর বাবা ঢাকায় ব্যবসা করেন। সে অর্থ-বিত্তের মাঝে বড় হয়েছে। তার বান্ধবী ছিলেন নেশায় বিভোর। অজান্তেই একদিন বান্ধবী নাদিরা ধরিয়ে দিলেন সিগারেট। একদিন-দু’দিন করতে করতে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে যান চৈতী।
বান্ধবী নাদিরার পরিবার অতটা অর্থবিত্তশালী নয়। তাই নাদিরা বান্ধবী চৈতীকে প্রতিদিন নগরীর চর্থা থেকে মাদক এনে দেয় বিনিময়ে পান অর্থ। এক সময় নাদিরার পরিবার বিষয়টি জানতে পেরে কুমিল্লার একটি বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করায়।চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হয়ে এখন রীতিমতো পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কারুন এবং লিজা (ছদ্মনাম) দম্পতি। কারুন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পড়াশোনার সময় একই ডিপার্টমেন্টের বান্ধবী লিজাকে বিয়ে করে। কারুন ও লিজা পেশায় ডাক্তার। মেডিকেলে পড়াশুনার সময় নেশার জগতে জড়িয়ে পড়েন কারুন। ধূমপান দিয়ে শুরু হলেও পরর্তীতে ইয়াবা, গাঁজা, মদ্যপানসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হন। এক সময় মেডিকেল কলেজের আবাসিক হলে বন্ধুদের সঙ্গে নেশা করলেও পরবর্তীতে তার ভাড়া বাসায় বসে নেশা শুরু করেন। পরে নেশার পার্টনার হিসেবে স্ত্রীকে যুক্ত করেন। এক সময় দু’জনই মাদকাসক্ত হয়ে ওঠেন। নিয়মিত মাদক না নিতে পারলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন। কোথাও খাবার খেতে বের হলে নেশার কারনে প্রকাশ্যে স্বামী-স্ত্রী নেশা কাটাতে সিগারেট খেত। পরে স্বাভাবিক হলে লোকলজ্জার বিষয়টি বিবেকে নাড়া দিত। এক পর্যায়ে তাদের মাদক সেবনের বিষয়টি সামনে আসে। তারাও এক সাথে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে  ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ৫ মাস।
সামিয়া। কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের শিক্ষার্থী। পরিবারের সাথে থাকেন দক্ষিণ চর্থা একটি ভাড়া বাসায়। শাওন নামের একটি ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে গড়ে উঠে। শাওন কুমিল্লা জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী। স্কুল ছুটির পর তার সাথে কোচিং-প্রাইভেটের নাম দিয়ে আড্ডা দেন। তাদের প্রেমের সম্পর্কে একটু ঝগড়া হলে তারা কিছুদিন আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সামিয়া তার মডার্ন স্কুলের বান্ধুবীদের সাথে আড্ডার ফলে প্রথমে সিগারেট পরবর্তীতে তার সঙ্গ দিতে গিয়ে আইস, শিসা ও ইয়াবায় আসক্ত হন। সন্ধা হলেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাসায় মাদক নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠে। এক পর্যায়ে পড়াশোনায় অনিয়মিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে শুরু করেন। নেশার টাকা যোগাতে পরিবারের কাছে মিথ্যা কথা বলে টাকা নেয়া, ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে পুনরায় মাদকে জড়ান এই শিক্ষার্থী।
কুমিল্লার জেলা পুলিশের তথ্যে বলছে, দেশে ২৩ থেকে ২৪ ধরনের মাদক থাকলেও মাদকসেবীরা ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক সেবন করছে। ‘গ্যাং কালচার’ কিশোর-তরুণ, পথশিশু, হতাশাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো ভাবে মাদক গ্রহণ করছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কুমিল্লার হিসাব অনুযায়ী, কুমিল্লায় কয়েক লাখ শিশু মাদকাসক্ত এবং তাদের মধ্যে শতকরা ১৫ ভাগ শিশু মাদক গ্রহণের খরচ মেটাতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নারী মাদকসেবীর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সে অনুযায়ী কুমিল্লার মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ও মানসিক হসপিটালে ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৫০  জন নারীকে চিকিৎসা দিয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৫ জন পুনরায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তাদের বেশিরভাগ নগরীর দক্ষিণ চর্থা, টিক্কারচর,চকবাজার, সদর দক্ষিণের কনেশতলা, দেবিদ্বারের চরবাকর-উনজুটি, কসবার সদরের অসংখ্য নারী।এসব নারীর মধ্যে ইয়াবা, গাঁজা, ঘুমের ওষুধসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের মাদক মদ,শিরায় মাদক নিয়েছেন। যাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া, মুড ডিজঅর্ডার, বাইপোলার ডিপ্রেশন, ওসিডি ও বাকিরা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত।
বন্ধুদের চাপ, একাকিত্ব, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, বিষণ্নতা, হতাশা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিচ্ছেদ, সন্তানকে সময় না দেয়ার প্রবণতা- এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ডা. শরীফ বলেন, পুরুষের তুলনায় খুব কমসংখ্যক মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসা নিতে আসেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় প্রেমিক- প্রেমিকা, শিক্ষার্থী,বয়স্ক নারী, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।
এক ভিভাবক বলছেন, আমি নিজেই আমার মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় আছি।আমার মেয়ে স্কুলে কিছু খারাপ ছেলে-মেয়ের সঙ্গ পেয়ে এসব মাদকে আসক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ে। পরে লোকলজ্জার ভয়ে ঢাকায় গিয়ে তাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হয়েছে।এতে আমার প্রায় ৯ লক্ষ টাকার মত ব্যয় হয়েছে।
কুমিল্লা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালী আমাদের কুমিল্লাকে বলেন, বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে। বন্ধু, প্রতিবেশী, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি থেকে মাদক গ্রহণ করে থাকে নারীরা। গণমাধ্যমে মাদকের কুফল নিয়ে অনেক বেশি প্রচার- প্রচারণা, স্কুল-কলেজে বিভিন্ন সময়ে মাদকবিরোধী সেমিনারের আয়োজন করা, সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখার মাধ্যমে নারীদের মাদকে আসক্তির ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবু জাফর খান বলেন, শিক্ষার্থীর ক্লাস করে ২ ঘন্টা, এরপর তারা কি করে তাতো আমাদের অবগত নয়। তবে শিক্ষার্থীরা যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে এর জন্য আমাদের সকল শিক্ষকমণ্ডলী পাঠদানের পাশাপাশি মাদক থেকে বিরত থাকতে অনেক শিক্ষাও দিয়ে থাকে।আর কুমিল্লায় ৪০ গজ পর পর মাদক পাওয়া যায়।যেহেতু পাশেই বর্ডার,সেহেতু মাদক আমদানিটা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যারাই আছেন,তারা যদি বন্ধ করতে পারত।তাহলে এই মাদক থেকে আমাদের সমাজ দূরে থাকত।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বিপিএম বলেন, রাস্তাঘাট যে সকল শিক্ষার্থী মাদক সেবন করেছে,পরে আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে বুঝিয়ে বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তর করেছি। পরিবারের সকলে চেষ্টা করলে ও সচেতন থাকলে মাদকসক্ত থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখা সম্ভব।