তিতাস পাড়ে গল্প-আড্ডা ও সাংবাদিকতা –খলিলুর রহমান

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতি
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

ভোরে ফজরের নামাজের পরপর প্রস্তুত হয়ে রুম থেকে বের হয়েই ফোন দিই কুভিকসাসের সভাপতি আবু সুফিয়ান ভাইকে। তখন ঘড়িতে সময় ৬ টা ৫৩ মিনিট। তিনি তখন শাসনগাছা রেলক্রসিংয়ের দিকে যাচ্ছেন। আমাকে রেলক্রসিংয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। পুতুল আপু তখন লালমাই থেকে আসছেন। কিবরিয়া ভাই দেবিদ্বার থেকে রওনা করে কাছাকাছি চলে এসেছেন। আমি সোজা রেলক্রসিং এ চলে আসলাম। মিনিট দুই পর সুফিয়ান ভাই এবং পুতুল আপুও আসলেন। যদিও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না কয়জন যাব তবুও আমরা কুমিল্লা থেকে আখাউড়া জংশনের পাঁচটি টিকেট নিলাম। ৭টা ৫০ মিনিটে ট্রেন আসার কথা। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের অপেক্ষার মাঝেই কিবরিয়া ভাই, সাফায়েত ভাই, অপি ভাই এবং গায়িকা তানিয়া আপু এসে পৌঁছলেন। সবাই মিলে আমরা রং চা পান করলাম। শীতের সকালে দক্ষ হাতে বানানো ধোঁয়া উঠা চা দারুণ লেগেছে। আমরা একক এবং গ্রুপ ছবি নিলাম কয়েকটা। ট্রেন আসলো ৮ টা ১০ মিনিটে। এতক্ষণ আমরা সবাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। যাত্রী নামার পর সবাই উঠে পড়লাম ট্রেনে।

আমরা ট্রেন ভ্রমণে অভ্যস্ত হলেও,কিবরিয়া ভাইয়ের জন্য এটা ছিলো জীবনে প্রথম ট্রেন ভ্রমণ । বগিতে এমন গাদাগাদি অবস্থা যে-বসার জায়গা তো না-ই দাঁড়ানোর জায়গাও সুবিধাজনক ছিলো না।এত মানুষ কোত্থেকে যে আসে! আমরা কেউ সিট না পেলেও পুতুল আপু কিভাবে যেন ভুজুংভাজুং দিয়ে একটা সিট ম্যানেজ করে ফেললেন। তিনি এই কাজটা খুব ভালো পারেন। যেখানে আমরা বলি না, হবে না। সেখানে তিনি বলেন- কেন হবে না? অবশ্যই হবে। এবং শেষ পর্যন্ত হয়ও। বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে করতে এগিয়ে যাই আমরা। হাসি-ঠাট্টায় মেতে থেকে ভুলে যাই দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট। ঘন্টাখানেক পর দুটো সিট খালি হওয়ায় পালা করে বসি কয়েকজন। যেভাবেই হোক ভ্রমণ আনন্দময় হওয়া চাই।

আখাউড়া রেলওয়ে জংশনে নেমে- জংশন সংলগ্ন বাজারে যাই আমরা। চলে যাই কল্লা শাহের মাজারে।
মাজারের পাশের রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে চলে আসলাম তিতাস নদীতে। শুকনো মৌসুম তাই নদীতে পানি নেই। অদ্বৈত মল্লবর্মণ যখন মালোদের নিয়ে তার বিখ্যাত উপন্যাস- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লিখছিলেন, তখন তিতাসের সৌন্দর্য আরও বেশি মনোমুগ্ধকর ছিল। নতুবা এত চমৎকার উপন্যাস লেখা হয়তো হতো না। আমরা দেখলাম চারিদিকে ফসলি জমি, কৃষকেরা ধানের চারা বুনছে। জমির চারপাশ ঘিরে আলপথ। আমরা সবাই আগাতে থাকি আলপথ ধরে। তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ের দিকে গভীরতা বেশি। সেখানে পানির উপরে নৌকা ভাসছে। ওপারে চান্দি নামক গ্রামের লোকেরা নৌকা দিয়ে ওপারে যাচ্ছে। মাজার সংলগ্ন বাজার থেকে সদাই নিয়ে নৌকায় করে ঘরে যাচ্ছে অনেকে। অ তিনদিকে বিস্তৃত খোলামাঠ,একদিকে ছলছল করা নদীর পানিতে নৌকা ভাসছে,ভাসছে কচুরিপানা। অসাধারণ এক মুহূর্ত। আমরা সবাই মিলে ধরলাম বাউল গান- জাত গেল জাত গেল বলে এ কি আজব কারখানা, আমার হাড় কালা করলাম রে,লোকে বলে ও বলে রে। সমস্বরে গলা ছেড়ে গাইলাম আমরা।


তিতাস একটি নদীর নাম তবুও তার বিস্তৃতি আর গভীরতা অত বেশি না যে,সারাবছর পানি থৈথৈ করবে। প্রত্যাশার বাইরে যেকোন কিছু পেলে আনন্দটা বেশিই হয়। নৌকাতে ভাসতে ভাসতে গান গাওয়ার ফিলিংসই অন্যরকম। তিতাসের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে চান্দী গ্রামের যেসব মানুষের বসবাস, তাদের বেশিরভাগই মাজার সংলগ্ন বাজারে সদাই করতে আসেন। অনেকের ব্যবসা বা কর্মক্ষেত্র এদিকেই। নৌকাতেই আসা-যাওয়া করতে হয়।নৌকাতে আমাদের সাথে গ্রামের মানুষও উঠেছেন কয়েকজন। সবাই নৌকাতে ভাসতে ভাসতে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। অদূরেই একটা মাঝারি পরিসরের কড়ই গাছ। ছায়াযুক্ত গাছটির চারপাশে পাকা করা বসার জায়গা। পাকার সাথে সংযুক্ত শানবাঁধানো ঘাটলা। বিশ্রাম নেয়ার জন্য চমৎকার একটি জায়গা। যদিও দূরত্ব খুবই কম তবুও কাঁদা-পানির কারণে আমরা সেখানে যেতে পারিনি। কিছু সৌন্দর্য দূর থেকে উপভোগ করাই শ্রেয়।

এরপর গেলাম কল্লা শহীদ (র)’র মাজারের পশ্চিম গেইটে। মাজার চারিদিকে নিরাপত্তা প্রাচীরে বেষ্টিত। আমরা সবাই একসাথে ভিতরে ঢুকলাম। গেইট সংলগ্ন মাঠে অনেকে রোদে বসে আছে। পুতুল আপুর পরিচিত এক ভাই মাজারের খাদেম। খুবই আন্তরিকতা দেখালেন আমাদের প্রতি। গতকাল রাতে সাপ্তাহিক জলসা হয়েছে। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার রাতেই জলসা হয়। বার্ষিক মাহফিল হয় আগস্ট মাসের ১০-১৬ তারিখ পর্যন্ত।

স্থলবন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। রৌদ্রজ্জল দিন,হালকা বাতাস, পরিচ্ছন্ন পাকা সড়কের দুপাশে সবুজ গাছপালা দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।সারাদিনে এই টুকরো জার্নিটা একটু বেশি উপভোগ্য লেগেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই আখাউড়া স্থলবন্দর গেইটে। লতা জড়ানো কাঁটাতারের বেড়া চোখে পড়ে। চোখে পড়ে বাংলাদেশ আর ভারতের পতাকা। জুমার নামাজের সময় হওয়ায় আমরা নামাজ পড়ে নিলাম। পার্সপোর্ট কিংবা বিশেষ অনুমতি ব্যতীত ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয় না। আখাউড়া স্থলবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ফ্ল্যাগ ডাউন দেখা। সন্ধ্যার কতক্ষণ আগে বন্দরের কার্যক্রম যখন বন্ধ হয়ে যায়,তখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা সামরিক কায়দায় সম্মান জানানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারতের পতাকা নামিয়ে ফেলেন। এটাকেই বলা হয় ফ্ল্যাগ ডাউন। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম প্রতি শনি ও রবিবার ফ্ল্যাগ ডাউন দেখা যায়। আমরা কিছুটা আশাহত হলাম।

স্থলবন্দর সীমানা থেকে বের হয়ে অটোতে করে আবারও আমরা আসলাম বাইপাস। বাইপাস থেকে বাসে উঠলাম ফারুকী পার্কের (শহীদ স্মৃতিসৌধ) উদ্দেশ্যে।সবার কাছে এই স্থানটি অবকাশ নামে পরিচিত। দুপুরের খাবার না খেয়েই বাসে উঠেছি সবাই। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিলো। ঠিক ঘুম না হলেও, তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম কিছুক্ষণ। দুপুর তিনটার দিকে আমরা পৌঁছলাম কাউতলা বাজারে। সবাই তখন ভীষণ ক্ষুধার্ত। হোটেল রাজধানী-তে ঢুকে দুপুরের খাবার খেলাম সবাই। মনে হচ্ছিলো যেন কয়েকদিন যাবৎ খাইনি। খাওয়া শেষে ডেজার্ট হিসেবে কেউ বোরহানি,কেউ মিষ্টি খেয়েছি।

 

অবশেষে শহীদ স্মৃতিসৌধে : হোটেল রাজধানী থেকে বের হয়ে আমরা সরাসরি চলে যাই ফারুকী পার্কের শহীদ স্মৃতিসৌধে। স্তম্ভগুলো ক্রমান্বয়ে একটা থেকে আরেকটা বড়। পার্কে প্রচুর গাছপালাও আছে। স্তম্ভের একটু সামনেই বড় পুকুর। পুকুরের পাড়ে ইটের তৈরি ইংরেজিতে একটি লিখিত স্থাপত্য। লেখা আছে-

I love Brahmanbaria

 

। পুকুরপাড়ে এবং স্মৃতিসৌধের সামনে কিছু ছবি তুললাম আমরা । তারপর সভাপতি সাহেবের নির্দেশে আমরা সবাই গোল হয়ে বসলাম। তিনি আমাদেরকে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। কিছু অভিজ্ঞতাও শেয়ার করলেন। আরো কিছু দিকনির্দেশনামূলক কথাবার্তা বলে সফরের সমাপ্তি টানলেন। অন্য কয়েকজনও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শমূলক কথা বললেন।

জংশনের পাশেই তৈরি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত গাভীর দুধের চা।আমরা সবাই তৃপ্তি করে চা খেলাম। চা খাওয়া শেষ হওয়ার পর জংশনে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন চলে আসলো।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে তখন।কিছুটা আলো-আধারীর মাঝেই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠে গেলাম আমরা।

একদিনের এই আনন্দ উচ্ছ্বাস ভরা ভ্রমণ আমাদের লেখার মান উন্নয়নে,অভিজ্ঞতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। ট্রেন ভ্রমণ ও গল্প আড্ডায় সাংবাদিকতা’র আমাদের এই যাত্রা সফল এবং সার্থক।

সদস্য: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতি (কুভিকসাস)।