গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখ যোদ্ধা কাজী ফখরুল মামলার আসামি!

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৪ সপ্তাহ আগে

কাজী ফখরুল আলম বাবুল। সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। বয়স ৬৩ পেরিয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পুরোটা সময় ঢাকার রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, জুলাই ও আগস্ট মাসে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন তিনি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন। রাজপথে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি সরব ছিলেন অনলাইনেও। স্ত্রী বাঁধা দিতে পারে এই ভয়ে কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে লুকিয়ে লুকিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আন্দোলনে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পানি ও শুকনা খাবারও তিনি দিয়েছেন। নিজে স্লোগান দিয়ে উজ্জিবিত করেছেন তরুণ প্রজন্মকেও। সেই ফখরুল আলমকে মামলা দেওয়ার কারণে ছি.ছি. ঘৃণার রব উঠেছে নগর কুমিল্লায়। প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে গোটা গণঅভ্যুত্থানও।

জানা যায়, ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশ ব্যাপী তুমুল আলোচিত ,সমালোচিত অধ্যায় ছিল ৩ আগষ্ট।

এদিন, কুমিল্লা নগরীর পুুলিশ লাইনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর বিশেষ করে মেয়েদের উপর পাকিস্তানী বর্বর হায়েনাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের কুমিল্লা মহানগরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। সেদিন নিরস্ত্র মেয়েদের উপর নির্যাতন ও নিপিড়নের স্টীম রোলার চালিয়েছিল আওয়ামীলীগের ক্যাডাররা। সেই নিন্দনীয় ঐতিহাসিক ৩ আগস্টের ঘটনার মামলা করা হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানায়।

জানা গেছে, এই মামলায় কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারসহ ২৬১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। কাজী ফখরুল আলম বাবুল মামলার ২৩৫ নম্বর আসামি। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়। যেই ৩ আগস্টের ঘটনায় কাজী ফখরুল আলমকে আসামী করা হয়েছে ঠিক ঐ দিন ঐ সময় কাজী ফখরুল ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে স্লোগান দিচ্ছেন। এমন অসংখ্য ভিডিও  কুমিল্লার জমিনের হাতে রয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারিই কাজী ফখরুল আলম জানতে পারেন, কুমিল্লা পুলিশ লাইন এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এমন ঘটনায় হতবাক তিনি। হতবাক তার পরিবার, বন্ধু ও স্বজনরা। গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের কুমিল্লা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মোল্লা তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, কাজী ফখরুল আলম। সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। কাজ করেন আর বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে বেড়ান। গত বন্যায়ও দেখেছি আমাদের এলাকায় চিকিৎসক ও ওষুধ নিয়ে হাজির। জুলাই আগস্ট আন্দোলনে তাকে মানুষের পক্ষে সরব দেখেছি। মাঝে মধ্যে তাকে নিয়ে ভয় হতো। কখন না গ্রেফতার হয়ে যান। কাল এক মামলা দেখে হাসলাম। তিনি সাবেক এমপি বাহারসহ ছাত্রদের ওপর হামলার আসামি। এসব মামলা কারা কেন করছে বা করাচ্ছে জানি না। এ রকম আজগুবি আসামি দিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করা হচ্ছে না তো?

ওই পোস্টে কাজী ফখরুলের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ভিডিও জুড়ে দেন তিনি। পোস্টে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করেন ও শেয়ার করেন।

কুমিল্লা প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক ও সময় টিভির কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি বাহার রায়হান একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা কাজী ফখরুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা। ৩ আগস্ট কুমিল্লা পুলিশ লাইন এলাকায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছেন বলে অভিযোগ। অথচ সেদিন তিনি ঢাকায় আন্দোলনে ছিলেন।

কাজী ফখরুলের বিষয়টি নিয়ে হতবাক হয়ে তার পরিচিত ও শুভাকাঙ্খীদের এরকম অসংখ্য পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে।

এ বিষয়ে কুমিল্লা মহানগরীর বিভিন্ন পেশার প্রায় অর্ধশত নাগরিকের সাথে কথা বললে তারা প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, এই মামলায় কাজী ফখরুল আলমের নাম যারা দিয়েছে তারা গর্হিত অপরাধ করেছে। যারা এর নেপথ্যে কাজ করেছে তাদের প্রতি ঘৃণা ও নিন্দা জানানো ছাড়া আর কিছুই নেই। অবিলম্বে তারা এই মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

কাজী ফখরুল আলম বাবুল জানান, ‘৩ আগস্ট আমি কুমিল্লায় ছিলাম না। ওই দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার মিছিলে ছিলাম। মামলাকে দুর্বল করতে পরিকল্পিত ভাবে আমাকে আসামি করা হয়েছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুমিল্লা মহানগরের আহ্বায়ক আবু রায়হান এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার জমিনকে বলেন, ‘কাজী ফখরুল সাহেব সম্পর্কে আমি জানি। তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। উনার বিরুদ্ধে যদি মামলা হয় তাহলে আমার বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে। মামলা থেকে উনার নাম প্রত্যাহারের বিষয়ে আমরা চেষ্টা করছি।’

বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক, ‘আঙ্কেল গেইটাটা খোলেন না-গণঅভ্যুত্থান কুমিল্লা,২০২৪ গ্রন্থের লেখক ও গবেষক শাহাজাদা এমরান বিস্ময় প্রকাশ করে কুমিল্লার জমিনকে বলেন, ২৪’র গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসৈনিক , সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও আজীবন জাতীয়তাবাদী ঘরনার ধারক ও বাহক কাজী ফখরুল আলমের বিরুদ্ধে মামলার কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, যে কোন সময় উপদেষ্টা আসিফ,নাহিদসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়ে যেতে পারে। অসম্ভবের এই বাংলাদেশে সব কিছুই সম্ভব।

সাংবাদিক নেতা শাহাজাদা এমরান আন্দোলনে কাজী ফখরুল আলমের বিভিন্ন ভূমিকার সচিত্র প্রতিবেদন দেখিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, যিনি মামলার বাদী তিনি হয়তো কাজী ফখরুল সাহেবকে চিনেন না। কিন্তু কাজী ফখরুল সাহেবের নাম মামলায় যাদের ইন্দনে দেওয়া হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করা আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার স্বার্থেই দরকার। ২৪’র আন্দোলনে দুই হাজার ছাত্র জনতা শহিদ হয়েছে, হাজার হাজার দামাল ছেলেরা রাজপথে রক্ত দিয়েছে, আহত হয়েছে পতিত সরকারের মতো আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানোর জন্য নয়।

কুমিল্লার জমিনের এই ভারপাপ্ত সম্পাদক আরো বলেন,৩ আগস্ট কুমিল্লা পুলিশ লাইনে যারা পাকিস্তানী হায়েনার মতো আমাদের বোনদের উপর হামলে পড়েছিল , তাদেরকে রক্ষা করার জন্যই বাদীকে ভুল বুঝিয়ে এই মামলায় কাজি ফখরুল আলমসহ আরো বেশ কিছু নিরপরাধ মানুষকে জড়ানো হয়েছে। যাতে মামলাটি হালকা হয়ে যায় এবং প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।

সুতরাং প্রশাসনের কাছে আমার অনুরোধ, অনতিবিলম্বে কাজী ফখরুল আলমের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট এই মামলা সসম্মানে প্রত্যাহার করুণ এবং তদন্ত সাপেক্ষে খুঁজে বের করুন পতিত স্বৈরাচারের কোন দোসর এই মামলায় কাজী ফখরুল আলমের নাম দিতে বাদীকে উৎসাহিত করেছে।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খাঁন কুমিল্লার জমিনকে জানান, ‘মামলায় নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অভিযুক্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’