কুমিল্লায় অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে কিশোর গ্যাং

# নবাগত এসপি বললেন,কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে আমি জরো টলারেন্স
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

গত কয়েক বছর ধরেই কুমিল্লায় ‘কিশোর গ্যাং’ শব্দটি আলোচনায় রয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিশু-কিশোরদের তৈরি করা এসব গ্যাং প্রথমে ছোটখাট অপরাধে জড়িত ছিলো। কিন্তু এক সময় এসব শিশু-কিশোররা হিংস্র হয়ে উঠে। তাদের কোমল হাতেই ঝরতে শুরু করে তাজা রক্ত। বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এতোটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যে, প্রকাশ্যে কারও প্রাণ কেড়ে নিতেও ভয় পায় না তারা। নগরীর বিশিষ্টজনদের মত- পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় শিশু-কিশোররা বিপদগামী হয়ে পড়ছে। অভিভাবকরা সচেতন হয়ে সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তাহলেই এসব অপরাধ কমে আসতে পারে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার(২৩ আগস্ট্য) সকালে কুমিল্লার নবাগত পুলিশ সুপার মো.আবদুল মান্নান বিপিএম(বার) বলেন, আমি সবেমাত্র কুমিল্লায় যোগদান করেছি। কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে জেলা পুলিশের অবস্থান থাকবে জিরো টলারেন্স। এজন্য যা যা করা দরকার সব করব ইনশাআল্লাহ॥

আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালের পর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া এসব শিশু-কিশোরদের হাতে একের পর এক তাজা প্রাণ ঝরতে শুরু করে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালের মধ্যেই কুমিল্লা নগরীতে ৬টি খুনের ঘটনা ঘটায় কিশোর গ্যাং। এক পর্যায়ে ঐ বছরের শেষ দিকে কিশোরদের এসব অপরাধ দমনে কঠোর অবস্থানে যায় প্রশাসন। বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি একের পর এক অভিযানে অস্ত্রসহ আটক হতে থাকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কিন্তু এরপরও থেমে নেইে অপরাধ।

সর্বশেষ কুমিল্লা নগরীতে শাহাদাত হোসেন নামে (১৫) এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গত শুক্রবার (১৯ আগস্ট) কুমিল্লা নগর উদ্যানের পাশেই অবস্থিত কাস্টমস অফিস ও আওয়ার লেডি অব ফাতেমা গার্লস হাই স্কুলের সামনে এই ঘটনা ঘটে।
নিহত শাহাদাত নগরীর গাংচর এলাকার প্রাইভেটকার চালক মো.শাহ আলম ভূইয়ার ছেলে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত হয়েছে, আধিপত্য বিস্তার ও কিশোর গ্যাংয়ের পুরোনো বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধুমাত্র কুমিল্লা নগরীতেই কিশোর গ্যাংয়ের গ্রুপ রয়েছে কমপক্ষে ১৫টি। যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী। প্রশাসনের তৎপরতায় ২০১৯ সালের শেষের দিকে এসব অপরাধে জড়িত শিশু-কিশোররাও কিছুটা গা-ঢাকা দেয়। তবে ২০২০ সালের প্রথমদিকে দেশে শুরু হয় করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। প্রশাসন যখন করোনা মোকাবেলায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় থেকে আবারও সংগঠিত হতে থাকে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তারা যেন আগের চেয়েও বেশি তৎপর হয়ে উঠে। বর্তমানে কুমিল্লায় আগের তুলনায় ব্যাপকহারে বেড়েছে কিশোর অপরাধের ঘটনা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গ্রুপ গঠন করে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। র‌্যাক্স, এক্স, এলআরএন, সিএমএইচ, মডার্ণ, ঈগল, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজ, বস, রতনসহ অন্তত্ত ১৫টি নামে কিশোর গ্যাং দিনে দিনে বিপদগামী ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে।

গত ১২ আগস্ট খাবারের বিল চাওয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কুমিল্লা নগরীতে একটি রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। ওইদিন সকালে নগরীর ধর্মসাগর গেইট সংলগ্ন পিজা কালজুন রেস্টুরেন্টে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনাস্থল হতে পুলিশ রাব্বি নামের গ্যাংয়ের এক সদস্যকে আটক করে। এছাড়া কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বৃদ্ধির কারণে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়লে চলতি বছরের ১৫ মার্চ নগরীর দৌলতপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গত বছরের ৩০ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৪টায় কুমিল্লা ইপিজেডের একটি চীনা কোম্পানির কর্মকর্তা খায়রুল বাশার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইপিজেডের সামনে কয়েকজন দুর্বৃত্ত তার পথরোধ করে। পরে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ওই বছরের ৮ মে মো.মহিউদ্দিন নামের এক কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যে র‌্যাব জানতে পারে, ৭-৮ জন ভাড়াটিয়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে চীনা কোম্পানির ওই কর্মকর্তা খায়রুল বাশার খুন হয়েছিলেন।

গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার একটি খেলার মাঠে মোহাম্মদ আমিন (১৫) নামের এক কিশোরকে পিঠে ও বুকে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের অজুহাতে তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে ১৯ বছর বয়সী তরুণ পারভেজ হোসেন। যদিও এই খুনে পারিবারিক বিরোধের বিষয়ও খুঁজে পায় পুলিশ। সেদিন খুন হওয়া আমিন ছিলেন একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল নগরীর মদিনা মসজিদ এলাকার আলভী টাওয়ারের অদূরে ‘তুই’ বলা নিয়ে কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোমতাহিন হাসান মিরনকে (১৪) হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলো মোহাম্মদ আমিন। ওই ঘটনার পর থেকে সে জেলে ছিলো। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে জামিনে বের হয় সে।

জেলা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৮ জুলাই নগরী সংলগ্ন চাঁনপুর এলাকায় রাশেদুল ইসলাম শাওন নামে এক তরুণকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করে একটি কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য। পরে ২০ জুলাই ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হত্যাকারীরা ওই তরুণকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করে গালাগাল করে। এতে ওই তরুণ প্রতিবাদ করাতে তাকে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের ১৪ মে রাতে নগরীর মোগলটুলি এলাকায় মোটরসাইকেলে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে কিশোর গ্যাং ‘ঈগল’ বাহিনীর সদস্যরা ওই বছরে এসএসসি পাস করা আজমাইন আদিলকে ছুরিকাঘাত ও দায়ের কোপে খুন করে। ২০১৮ সালের ১১ জুলাই প্রেম-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ধর্মসাগরপাড়ের নগর উদ্যানে ছুরি দিয়ে খুন করা হয় কুমিল্লা অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শিহাব উদ্দিন অন্তুকে। ২০১৯ সালের ১০ মার্চ নগরীর দিশাবন্দ এলাকায় ক্রিকেট খেলায় তর্কের জের ধরে সাজ্জাতুল ইসলাম (১৬) নামের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ২১ এপ্রিল ভাড়া নিয়ে বিরোধের জেরে নূরপুর এলাকায় দুই কিশোর ছাত্রের ছুরিকাঘাতে গুরুতর জখম হয়ে ২৩ এপ্রিল মারা যান অটোরিকশাচালক শাহজাহান। ২০১৭ সালের ২৭ মে নগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকায় ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহাজাদা ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পুরো নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আগের চেয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। আর অভিভাবকরাও এখন সন্তানদের প্রতি খুব একটা নজর দেন না। যার কারণে এসব অপরাধ ব্যাপক হারে বেড়েছে।

মানবাধিকার সংগঠক ও সনাক কুমিল্লার সাবেক সভাপতি আলী আকবর মাসুম বলেন, আমাদের তরুণ ও যুব সমাজ, বিশেষ করে যাদের বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে তারা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ থেকে বর্তমানে ভালো কিছু পায় না। তারা সুস্থ বিনোদন এবং পারিবারিক বন্ধন থেকেও ভালো কিছু পাচ্ছে না। আবার দেখছে অবৈধ উপায়ে অর্থ আয় করাও সহজ। কোথাও ভালো কিছু না পেয়েই এসব তরুণরা বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

কুমিল্লা কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ সহিদুর রহমান বলেন, সামাজিক অবক্ষয়, মাদক ও মোবাইলে আসক্তি এবং সহজ যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় এসব কিশোররা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বা তাদের আগ্রহ নেই। পরিবার থেকেও শিশু-কিশোরকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না। যার কারণে তারা সহিংস অপরাধে জড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িতদের নজরদারিতে রাখার চেষ্টা করছি। এছাড়া কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের আরও বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো কিশোর অপরাধ বন্ধ করতে হলে পরিবারকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদেরতে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।

শাহাজাদা এমরান
০১৭১১৩৮৮৩০৮
২৩.৮.২২