পথ চলার পথ মুক্ত ও নিরাপদ হোক সবার জন্য —— আলী আকবর মাসুম

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

পায়ে হেটে চলা বা পথ চলার মাঝে তফাৎ থাকলেও দুটোকে একভাবে চলাচল বলা যায়। পায়ে হেটে চলার বাইরে মানুষ অন্যান্য মাধ্যমেও পথ চলেন। নিকট দূরত্ব ছাড়া দূর দূরত্বেও মানুষ কে চলাচল করতে হয় জীবন ও কর্মের নানা প্রয়োজনে। যানবাহন বা যান্ত্রিক বাহন দূরের কোনো গন্তব্যের জন্য সবসময় ব্যবহার হয়ে থাকলেও নিকটবর্তী চলাচলে সাধারণ কোনো বাহনেই পথ চলতে বলা যায় আমরা সবাই অভ্যস্ত। আর যদি হয় অতিনিকট কোনো স্থানের উদ্দেশ্য, সেক্ষেত্রে পায়ে হেটে পার হতে চান, এমন মানুষও কোথাও কম নন। কাছের কোনো স্থানে চলাচলে পায়ে হেটে চলা যেমন সাশ্রয়ী, আবার স্বাস্থ্যসম্মত বলেও অনেকের কাছে তার গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া পায়ে হেটে পথ চলতে ছন্দ- আনন্দের অনুভুতি খুঁজে পান, এমন অনেক মানুষও এভাবে পথ চলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু কথা হচ্ছে সড়কের এক পাশ ধরে কারো পক্ষে পায়ে হেটে চলা এমন আর আগের মতো সহজ নয়। নগর ও শহরে বসবাসের প্রাধান্যে সর্বত্রই মানুষের অতিরিক্ত চাপ বাড়ছে, বড় যানবাহনের সঙ্গে বৈধ , অবৈধ যান্ত্রিক বাহনের সংখ্যাও কেবল বেড়েই চলছে। তার ওপর ফুটপাত ও প্রধান সড়কের উপর হকার ও দোকানীদের ব্যবসা খুলে বসার দৃশ্য তো আছেই। ফলে কুমিল্লা নগরীর প্রধান সড়ক ও ব্যস্ততম এলাকাগুলোর কোথাও স্বস্তির পথ চলা এখন যেন অনেকটাই অসম্ভব হয়ে গেছে। এদিক থেকে বললে পায়ে হেটে চলা কিংবা কোনো বাহনে চড়ে পথ চলা দুটোই যেন কুমিল্লার মানুষের কাছে কখনো বিরক্তির, কখনো বা বিরম্বনায় পরিণত হয়েছে। আমার এসব কথাগুলো এক অর্থে নতুন কিছু নয়। কারণ বহু আগে থেকে রাজধানী ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় নগরী গুলোর প্রায় সবটা জুড়ে যেরকম যানজট ও মানুষের চলাচলে যে দুর্ভোগ তার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দিনে দিনে কুমিল্লার মানুষকেও প্রায় একই পরিস্থিতির পরিনাম বরণ করতে হচ্ছে। পায়ে হেটে চলা বা নির্বিঘ্ন পথ চলাসহ গত বার বছরের নগর জীবনে স্বাচ্ছন্দের জীবন যাপনের সুযোগ যেন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে।
আমাদের দেশে মানুষের বসবাসের পর্যায় গুলোকে নির্দিষ্ট করে চিহিৃত করলে- গ্রাম, শহর ও নগর এই তিনটি ভাগে দেখা যায়। বৈষম্য ও বঞ্চিতের অতিমাত্রা থেকে কিছুটা নিষ্কৃতির জন্য মানুষ সবসময় গ্রামীণ জীবন থেকে শহর কিংবা নগর জীবনে প্রবেশ করতে চান। বাস্তবতা ও যৌক্ত্কি বিচারে মানুষের এরকম চাওয়ায় কোনো ভুল নেই। কেননা দেশের যেকোনো স্থানে যে কেউ জন্মগ্রহণ করুন তিনি একই মর্যাদায় দেশের নাগরিক এবং সমান সুযোগ- সুবিধা লাভের দাবী রাখেন। তবে নগর বা শহর স্বীকৃত নির্দিষ্ট সীমানার এলাকাগুলোও যখন সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োপযোগীতার বিবেচনায় উপযুক্ত মাত্রায় গড়ে না ওঠে তখন সেখানেও মানুষ আরেক ভাবে বঞ্চিত হতে থাকেন। অর্থাৎ নগর- শহর স্বীকৃতির অনুপাতে নাগরিক জীবনে নতুনত্ব ও নান্দনিকতার পরিবর্তে যদি অস্বস্তি ও অসন্তোষের বিষয়গুলো বড় হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে মানুষের আখাক্সক্ষা পূরণে অপূর্ণতা ও ঘাটতি থেকেই যায়। তাতে নগর, শহর উন্নীতের পরিচয়টি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ থাকে তেমনি তার সত্যিকার সুফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হন মানুষ। সব কিছুর আগে যে কোনো মানুষ বা নাগরিক তার অবস্থান থেকে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা ও ঘরের বাইরে সহজে স্বাভাবিক পথ চলার মতো একটি নির্বিঘ্ন পরিবেশ আশা করে থাকেন। প্রধানত প্রতিটি মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের দরকারি কাজকর্ম সেরে নেওয়ার জন্য ঘরের বাইরে যেতেই হয়। এজন্য নিকট দূরত্বে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বা চলাচল করতে সাধারণ বাহনে চলেন প্রায় সবাই। স্বল্প দূরত্বে পায়ে হেটে চলতেও অনেকে ইচ্ছুক থাকেন শরীর ও মনের কিছুটা শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টায়। দূর দূরত্বের পথে কোথাও কারো যেতে হলে সড়ক পথে ট্রেন, বাসের মতো যানবাহন বা ব্যক্তিগত গাড়িতে যেতে হয় সবার। এরকম যাতায়তেও নেই নিরাপত্তা ও নিরাপদ পথযাত্রা। প্রতিদিনই আছে কোনো না কোনো ঘটনা ও দুর্ঘটনা সহ সড়কে ভোগান্তির খবর। কোনো দূরের যাত্রায় মানুষ সব ঝুক্কি ঝামেলার কথা যেনেও বাধ্য হয়ে যাতায়ত করেন দূর দূরান্তে। কিন্তু যেখানে নিজের বসবাস অথবা নিজের শহর বা নগর হিসেবে সবসময় থাকতে হয়, চলতে হয়- সেখানেও পথ চলা কষ্টকর কিংবা ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাবে তা কিছুতেই মানা যায় না। সেই সাথে কুমিল্লা নগরীর রাস্তায় পায়ে হেটে বা পথ চলতে গিয়ে কিছু মানুষ একটু না একটু আতঙ্কিত তো থাকেনই। বয়স্ক নারী- পুরুষরা নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে খুব প্রয়োজন না হলে চলাচল না করতে পারলেই যেন বাঁচেন। একজন অন্যজনের গায়ের ওপর পরা ছাড়াও বেপরোয়াগতির অটো বা ব্যাটারী চালিত রিকশার ধাক্কা খেয়ে হাত ভেঙ্গেছেন, শরীরে আঘাত পেয়েছেন এমন ঘটনাও কম নয়। নারী- শিশুদের পায়ে হেটে বা কোনো বাহনে পথ চলতে গিয়েও মাঝে মধ্যে পড়তে হয় অশোভন, অস্বস্তিকর অবস্থায়। বৈধ- অবৈধ অতিরিক্ত যানবাহনে রাস্তা দখল, হকারদের ফুটপাতে অবস্থানের সঙ্গে রাস্তায় পথ চলা মানুষের ভীড়ে চুরি ও ছিনতাইয়ের অপরাধ ও অপরাধীদের তৎপরতাও বেড়েছে নগরীতে। শব্দ ও বায়ূ দূষণের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং সহনীয়তার ক্ষমতাও কমছে অনেকের। তাহলে একথা বলাই যায়- এরকম বাধা ও প্রতিকূল অবস্থার মুখে নগরীতে মানুষের পায়ে হেটে চলা এবং কোনো বাহনে পথ চলায় স্বস্তিকর ও শৃঙ্খলার পরিবেশের চেয়ে অস্বস্তিই বাড়ছে বেশি।
দেশে নগর, শহর উন্নীতের স্বীকৃতির পর তার রূপ-রূপায়নে বড় রকমের বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণার প্রসার যে ভাবে চলছে তার শেষ যদি না থাকে তাহলে কুমিল্লার ক্ষেত্রেও সমস্যা সমাধানের সহজ কোনো পথ নেই। আবার সরকারের প্রশাসন ও নগর কর্র্তৃপক্ষের তাতে কার্যকর কোনো প্রচেষ্টা যদি নাও থাকে তাহলেও নগরীতে পথ চলার প্রয়োজনীয়তা বাদ দেওয়ার কথা ভাবা যায় না। সব বয়সের নারী-পুরুষদেরই কোনো না কোনো অপরিহার্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগরীর রাস্তায় পথ চলতেই হয়। বয়স্কজন থেকে তরুণ- যুবরাও এই নগরীর রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে মাঝে মধ্যে হোঁচট খেলেও ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন সব অনিয়ম ও অসংহতির কথা। জীবনে সময় ও বয়সে এগিয়ে চলার নিয়মের পথ ধরে পায়ে হেটে চলা বা পথ চলার পথে আমাদের থাকতেই হয়। প্রাসংঙ্গিক ভাবে বলতেই হচ্ছে, অর্থ-সম্পদে ধনাঢ্য নন, তবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এবং পথ চলতে চলতে পথের খোঁজ দিয়েছেন বা দিয়ে যাচ্ছেন আমার দেখা এমন কজনকে আজও স্মরণ করি, জানাই শ্রদ্ধা। তাঁদের মধ্যে কুমিল্লার নানা পথ- প্রান্তে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেবল পায়ে হেটে যিনি মানুষের ভালো-মন্দের খবরের সঙ্গী ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী আমার কাছে আজও পথ দেখানো একজন পথের মানুষ। পছন্দের বাহন রিকশায় চড়ে মাথায় ছাতা ধরে শহরের রাস্তায় ঘুরে মনের প্রশান্তি ও কিছুটা আনন্দ অনুভবের সুযোগ খুঁজতেন দারোগাবাড়ীর বাসিন্দা প্রয়াত এডভোকেট আলী ইমামের মতো সাদামাটা মানুষের কথাও ভুলা যায় না। শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী কর্মজীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রয়োজনে কিংবা পথ চলার আনন্দে রিকশায় চড়েই পৌঁছে যান সবখানে এবং সবার কাছে। বরেণ্য গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবুল হাসানাত বাবুল। পুরো জীবনে তিনিও একজন পায়ে হাটা পথ চলা মানুষ। গোমতী নদীর পাড় থেকে শুরু করে কুমিল্লার কোথায় তিনি নেই বা আজ পর্যন্ত যাননি পথ চলার পথ ধরে। তাঁদের মতো এমন প্রতিটি মানুষ যেরকম সামাজিক পরিবেশ এবং সুগঠিত দেশের জন্য স্বপ্ন নিয়ে বাঁচেন ও সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে যান, তার কতটা মূল্য আছে বা নেই জানি না। তবে সত্যিটা হচ্ছে কর্তৃত্বের পদ, পরিচয়ের সঙ্গে মানুষের সততার শক্তি এবং সুদৃঢ় হাতেই স্বচ্ছ- সুন্দর সমাজ ও দেশ গড়ে ওঠতে পারে। আর তা হলে সুগঠিত দেশ বা নগর, শহরের চাওয়া অনেকটা বৃথাই থেকে যাবে। পথ চলার পথ মুক্ত ও নিরাপদ হোক সবক্ষেত্রে ও সবারজন্য।
লেখক- আলী আকবর মাসুম, মানবাধিকার বিষয়ক পরামর্শক, কুমিল্লা।