শাহাজাদা এমরান,কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে।।
জন্ম ভারতের এক জেঠার বাড়িতে হয়েছে বলে সবাই আদর করে আমার নাম রাখে বিদেশী চন্দ্র। নামে বিদেশী হলেও কপাল বিদেশ জোটেনি। জন্মের তিনদিনের মাথায় ভারত থেকে দেশে আসি। তখন নাকি আমাদের খুব অভাব অনটন ছিল। আবার তের বছরের মাথায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার জয়নাল মেকার ও হাছান শেখের অত্যাচার নির্যাতনে ভারত যাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি এসে দেখি সব কিছু জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়ে গেছে হানাদাররা। সুখ আমাদের কোথায়ও ছিল না। আত্মীয়স্বজনদের কাছে শুনেছি,তুলনামূলকভাবে আমরা যারা আসাম কিংবা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শরণার্থী ছিলাম তাদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থীরা। কারণ হিসেবে তিনি জানান,আমাদের এই উত্তরাঞ্চল থেকে যে পরিমাণ মানুষ শরণার্থী হয়েছে সেই তুলনায় ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী আমাদের ওই এলাকার মানুষ কিছুটা কম শরণার্থী হয়েছে। দুই আমাদের এখানকার আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকার শরণার্থীদের কোন খোঁজ খবর রাখত না। যা ঐ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারা রাখত। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা যারা ভারতের আসাম কিংবা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শরণার্থী ছিলাম তাদের থেকে অনেক বেশি তুলনামুলক ভাল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থান করা শরণার্থীরা। এ কথাগুলো জানালেন কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ^র উপজেলার ৫নং কামার পাড়া ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামের শ্রী বিদেশী চন্দ্র সরকার। তিনি গত ২ নভেম্বর স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এইড কুমিল্লা অফিসে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন । এ সময় সাথে ছিলেন এইড কুমিল্লার প্রজেক্ট ম্যানাজার মো. দেলোয়ার হোসেন।
শ্রী বিদেশী চন্দ্র সরকার । পিতা প্রাণকিষ্ট সরকার ও মাতা নস্কা বালা সরকার। পিতা মাতার ৭ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে তিনি ৫ম। ১৯৫৮ সালে ভারতের আসাম রাজ্যের গোলকগঞ্জের জেঠার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার নাগেস্বর উপজেলার ৫নং কামার পাড়ার ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামে । জন্মের তিন দিন পর তিনি বাবা মার সাথে দেশে চলে আাসেন।
দেশে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন তার বয়স তের বছর । আর্থিক সংকটের কারণে পড়াশুনা করতে পারেননি। ফলে ছোটকাল থেকেই কৃষিকাজ শুরু করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কেন ভারতে গেলেন জানতে চাইলে বিদেশী চন্দ্র সরকার বলেন, বাবারে কেউ তো আর সখ করে নিজের বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে অন্যের দেশে চলে যায় না, বাধ্য হয়ে যায়। দেশে কবে কখন যুদ্ধ শুরু হয়েছে এ কথা বলতে পারব না। বেশ কিছুদিন ধরেই শুনে আসছি পাঞ্জাবিদের সাথে আমাদের দেশের একটা বড় গ-গোল লাগবে। হঠাৎ করে শুনলাম গ-গোল শুরু হয়ে গেছে। শহরের মানুষগুলো গ্রামে আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে খুব সকালে রাস্তায় বের হলে দেখা যায় মানুষের স্্েরাত যাচ্ছে ভারতের দিকে। আমাদের পাশর্^বর্তী গ্রাম হলো কুলাঘাট। এটি লালমনিরহাট জেলায় পড়েছে। একদিন রাতে ঐ গ্রাম থেকে একটি বিকট আওয়াজ এলো। এত জোরে আওয়াজ এলো মনে হল যেন আকাশ থেকে আসমানটা ভেঙে পড়েছে। এরপরই শুরু হলো গগনবিদারি কান্নার আওয়াজ। একেবারে পাশর্^বর্তী গ্রাম। স্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শোনা যাচেছ আর মানষজন দৌড়াদৌড়ি করছে। তখনতো গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। চর্তুদিকে শুধু টর্চ লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। এরপর দিন সকাল থেকেই শুরু হলো চর্তুদিকে নানা তা-ব। কি হিন্দু কি মুসলিম কোন বাছ বিচার ছিল না। যুবতী মেয়ে একটু সুন্দর হলেই হলো। রাজাকার আর বিহারিরা তাদের ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পে। মেয়ে পেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা খুশি হতো, আর এ দিকে মানুষের বাড়ি ঘরে লুটপাট করত রাজাকাররা। বিশেষ করে রাজাকার জয়নাল মেকার আর হাছান বেগ পাঁচগাছিয়া এলাকার ফুলবাড়ি নামে একটি গ্রাম ছিল। পুরো গ্রামটিই তারা জ¦ালিয়ে দিয়েছিল। আর আমাদের পাশের আরেকটি গ্রাম ছিল শুকাতি নামের। এই গ্রামের আলিমবদি ফজর ব্যাপারী ছিল স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা। তার কাজ ছিল দুই দিন পর পর মানুষের গরু ছাগল ধরে জবাই করে নিজে খাওয়া আর হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে পাঠানো। সম্ভবত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমাদের গ্রামে আক্রমণ শুরু হয়। গ্রামের এক সাইডে হানাদার বাহিনীর অভিযান দেখেই বাবা বলল,এরপরতো আমাদের বাড়ি চলে আসবে। বাবা রাতেই মাকে জানাল, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখ আগামী সপ্তাহে ভারত চলে যাব। কিন্তু এ কথা বলার পরদিনই আবার পাকিস্তানি সৈন্যরা কুমোরপুর গ্রাম জ¦ালিয়ে দেয়। এই গ্রামের অপরাধ, এখানে কয়েকদিন না কি মুক্তিবাহিনী থেকেছে। এই ঘটনার সাথে সাথেই বিকাল ৩টার দিকে আমরা ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আমরা আমাদের কামার পাড়া থেকে হেঁটে নাখালগঞ্জ বাজার হয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার জেলার কালমাটি নামক এলাকায় যাই। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। যেতে যে কত কষ্ট হয়েছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন।
কালমাটি এলাকায় আমার মায়ের মামার বাড়ি ছিল। এখানে প্রায় ১৫ দিন ছিলাম। মায়ের মামাদের অবস্থাও ভাল না। আমরা বুঝতে পারছি আমাদের জন্য তাদের খুব কষ্ট হচেছ। ফলে বাবা বামন হাট ক্যাম্পে গেলেন। কিন্তু এই ক্যাম্প থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো এখানে এমনিতেই অতিরিক্ত লোক। এখানে রাখা যাবে না। আপনি অন্য ক্যাম্পে যোগাযোগ করেন। আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে সেদিন আমরা খুঁজে পাইনি। অথচ আমরা আমদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে শুনেছি, যারা ত্রিপুরা রাজ্যে ছিল সেই এলাকার আাওয়ামী লীগ নেতারা তাদের শরণার্থীদের অনেক দেখভাল করেছে। বাবা বৃষ্টি ভিজে বামন হাট থেকে মায়ের মামার বাড়ি আসে। এসে মাকে বলে জিনিস যা আছে সব দাও। মায়ের গলার জিনিস বিক্রি করে রাত ৮টার দিকে আমরা আসামের গোলকগঞ্জ যাই। ভাগ্য এমনই খারাপ যে এই ক্যাম্পেও আমাদের রাখার মত কোন জায়গা নেই বলে জানিয়ে দেন। এই পর্যায়ে আমরা সবাই কেঁদে ফেলি। এত রাতে কোথায় যাই।প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে। আমরা সবাই ভিজে কাকুতুয়া হয়ে গেছি। তখন একজন জানাল আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবেন। সামনে গবরীপুর ক্যাম্প আছে সেখানে যান। মা বাবা আমরা ভাই বোন আমাদের সবার শরীর ভিজে একাকার। বৃষ্টিতে ভিজে জ¦র জ¦র ভাব এসেছে। রাত ১টার দিকে ঐ ক্যাম্পে যাই। বাবা জানাল যদি এই ক্যাম্পে জায়গা না থাকে তাহলে রাস্তার উপর শুয়ে পড়ব আর কোথায় যাব না। ওখানে গিয়ে আমরা একটি কলেজের বারান্দায় উঠি। এখানেই রাত কাটাই। সকালে গবরীপুর ক্যাম্পের অফিসার এসে আমাদের চিড়া মুড়ি দিয়ে যায় এবং বলেন আপনারা এই স্কুলেই থাকেন। ক্যাম্পের সুযোগগুলো আমরা এখানেই দেব। পরে আরো অনেক পরিবারকে কলেজে আশ্রয় দিলো। এই কলেজে আমরা তিন মাস ছিলাম। তিন মাস পর আমরা যারা এই কলেজে ছিলাম তাদের অর্ডার এল গোসাইন গাঁও ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য। গোসাইনগাঁও ক্যাম্পে অনেক কষ্টে যেতে হয়েছে। এটা একটি পূর্ণাঙ্গ শরণার্থী ক্যাম্পে। একটি পরিবারের জন্য একটি ঘর। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এখানেই ছিলাম। এই ক্যাম্পে ঘর পেলেও রেশম কার্ড পাইনি। নানা জটিলতার কারণে আমরা যারা কলেজ থেকে এসেছি তাদের কার্ড করতে এক মাস সময় লেগে যায়। এই একমাস অর্ধহারে অনাহারে ছিলাম। বাড়ি থেকে হাড়ি পাতিল যা এনেছি সব বিক্রি করে খেয়েছি। এমন কি স্থানীয় বাজারে বাপ বেটা কুলির কাজ করেছি দুই মুঠো ভাতের জন্য। পরে যখন রেশম কার্ড পেলাম তখন দেখলাম রিলিফের মালের অবস্থা খুব খারাপ। চালের মধ্যে আটার মধ্যে কেরী পড়ে আছে। এগুলো খেয়ে কত মানুৃষ যে মারা গেছে তার কোন হিসেব নেই। শরণার্থী শিবিরের জীবন কথা বলতে গেলে একটা হিন্দি সিনেমার গল্প হয়ে যাবে। সেই দু:থ বলে কি লাভ এখন। কত মানুষ যে কত অবহেলায় মারা গেছে তার কোন হিসেব নেই। আমরা আমাদের বাড়িতে পশু পাখি মারা গেলে যেভাবে ফেলে দেই ঠিক তেমনই শত শত মানুষকেও এমনি করে মাটিতে পুঁতে রেখেছে কিংবা পানিতে ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না জীবিত ব্যক্তিদের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৫/১৬ দিন পর আমরা দেশে আসি। এসে দেখি আমাদের ঘর বলতে কিছুই নেই। কয়েক দিন স্কুলের বারান্দায় ছিলাম। পরে ঘর তুলে বাড়িতে আসি।
তিনি দু:খ করে বলেন, বাবারে দেশের স্বাধীনতা এভাবে আসেনি। এরজন্য আমরা যারা শরণার্থী ছিলাম আমাদেরও কম কষ্ট করতে হয়নি। সরকারের উচিত আমাদেরকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
Discussion about this post