তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে পাবজি, তিনপাত্তি ও ফ্রি ফায়ার বন্ধ করুন-শাহাজাদা এমরান

# মোবাইল গেমসে আসক্ত কিশোরদের জীবন বাঁচাতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ১ বছর আগে

নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বৈদ্যের বাজার এন এ এম পাইলট হাই স্কুলে ১৯৮৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় জীবনে প্রথম বিতর্ক করেছিলাম, ‘বিজ্ঞান আর্শিবাদ না অভিশাপ।’ তখন মোবাইল ফোন ছিল না। থাকলেও খুব একটা প্রচলন ছিল না। আমরা আর্শিবাদ এবং অভিশাপের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বলতে গিয়ে টিভি, রেডিও, ফ্যান, ঘড়ি, গাড়ি, ফ্রিজ বা বিমানসহ আরো কয়েকটি বিষয়কেই সামনে নিয়ে আসতাম। বিজ্ঞান তখন আজকের পর্যায়ে ছিল না বলেই আমাদের যুক্তিও সীমাবদ্ধ অবস্থায় ছিল।

আজ যদি এই বিষয়ের উপর বিতর্ক হয় তাহলে প্রথমেই আর্শিবাদে চলে আসবে বিজ্ঞানের অমর কৃতি মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট। যা আমাদের হাতের কাছে গোটা পৃথিবীটাকে নিয়ে এসেছে। আর বিপক্ষ দল অভিশাপের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলবে, মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে ছন্দপতন ঘটছে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ কিশোরের জীবনে।
আমাদের সদ্য মাধ্যমিকে পা রাখা শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ পাবজি, তিনপাত্তি, ফ্রি ফায়ার নামক মোবাইল গেমসের নেশায় এমন ভাবে জড়িয়ে পড়ছে যে, গোটা পৃথিবী আজ তাদের কাছে অন্ধকার মনে হচ্ছে। যে সময় তাদের ব্যস্ত থাকার কথা পড়ার টেবিলে কিংবা খেলার মাঠে। সেই সময়ে তারা তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ঘরকুনো হয়ে গেমসের নেশায় বুদ হয়ে রয়েছে। ১০-১৬ বছরে এসব কিশোর ও তরুণরা প্রতিনিয়ত স্মার্টফোনে গেমে আসক্ত হচ্ছে। ছন্দ হারাচ্ছে তাদের জীবন,পবিত্র স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে পিতা-মাতার।

মহামারী করোনা শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বকেই ব্যাপক বদলিয়ে দিয়ে গেছে। ছন্দপতন ঘটছে সার্বিক জীবন যাত্রায়। এই সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ থাকার কারণে শুরু হয় মোবাইলে অনলাইন ক্লাস (অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম)। ফলে স্মার্ট ফোন চলে যায় লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর হাতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কিশোর তরুণদের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দেওয়ার ফলে যতটুকু না তারা ক্লাস করে উপকৃত হয়েছে তার চেয়ে তিন গুণ বেশি তারা মোবাইল আসক্তিতে পড়ে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সাথে পারিবারিক, সামাজিক এবং সমষ্টিগতভাবে দেশও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। করোনার কারণে শুধু যে শিক্ষার্থীদের হাতেই স্মার্ট ফোন ছিল তা নয়, যে সকল কিশোর তরুণ পড়াশোনা করতো কিন্তু বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত ছিল তখন তারাও ঘরে বসে এই মোবাইলে আসক্তি হয়ে পড়ে।

চলতি বছরের ২২ মে (রোববার) দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, করোনার বিধিনিষেধে ঘরে থেকে মুঠোফোনে পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মতো অনলাইন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ে যশোরের ঝিকরগাছা পৌর শহরের এক কিশোর। মানসিক ভারসাম্য হারানো ওই কিশোরকে এখন শিকলে বেঁধে রাখা হচ্ছে। না হলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না বলে পরিবার দাবি করেছে।

১৭ বছর বয়সী এই কিশোরের বাবা সৌদি আরব প্রবাসী। তার পরিবারের সদস্যরা বলেন, ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর বছরে এলাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো ছেলেটি। বিধিনিষেধে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঘরে বসে মুঠোফোনে অনলাইন গেমসের নেশা তাকে পেয়ে বসে। পাবজি, ফ্রি ফায়ার এসব খেলায় আসক্ত হয়ে যায় সে। নিষেধ করলে শুনতো না। নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে খেলত। অনেক বকাঝকা করেও খেলা ছাড়াতে পারেনি পরিবার। এখন আর সে নিয়ন্ত্রণে নেই। আসক্তি এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরের আসবাব ভাঙচুর করে। সামলাতে না পেরে তাকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়। এখন সে ওই গেমসের লেভেল নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে।লোকজনের সঙ্গে এখন আর সে মিশতে চায় না। এ অবস্থায় তাকে স্কুলেও পাঠানো যাচ্ছে না।

এই উদাহরণ কিন্তু শুধু যশোরের ঝিকরগাছা পৌর শহরের ঐ এক কিশোরেরই না। এমন উদাহরণ আমাদের কুমিল¬াসহ সারা দেশেই লক্ষ লক্ষ কিশোরের। মানসম্মানের ভয়ে অনেক পরিবার মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছেন। চোখের সামনে পাবজি, ফ্রি ফায়ার খেলে প্রিয় সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখেও কিছুই করতে পারছে না। নিরবে নিভৃত্বে শুধু চোখের পানি ফেলছে।

ভিডিও গেমস নিয়ে আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন নয়। কিন্তু অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে এর প্রভাব অনেক বেশি। অনলাইন কিংবা ভিডিও গেমস খেলা এখন আমাদের শিশুরা মাদকের মত জীবন ধ্বংসকারী আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ গেমস আসক্তিকে সম্প্রতি ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শিশুদের অনলাইন ভিডিও গেম নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। অনেক দেশই শিশুদের ভিডিও গেমসের ওপর মনিটরিং করছে। কোন কোন দেশ এই মোবাইল গেমস নিষিদ্ধ করেছে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্রাতিরক্ত আসক্তির কারণে আমাদের একেবারে নিকট প্রতিবেশি দেশ ভারত ও নেপাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাদের তরুণ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। শুধু ভারত ও নেপালই না এ গেমসকে নিষিদ্ধ করেছে টেকনোলজির দেশ চীন, ইরাক ও জর্ডানও। আমাদের দেশও হাইকোর্টের একটি অর্ডারে এটি নিষিদ্ধ করার পর আবারও নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। কেন বাংলাদেশ পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মত তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসকারী এই মরণব্যাধি গেমসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল তা আমাদের সরকারই ভালো বলতে পারবে। ব্রিটেন, জার্মানি এবং চীনে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আলাদা চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। আমাদের দেশে অসম্ভব বেশী এই রোগির সংখ্যা বাড়লেও এ ধরনের পুনর্বাসন কেন্দ্র কিন্তু এখনও গড়ে উঠেনি।

চিকিৎসক ও সমাজ বিশেষজ্ঞের মতে, মোবাইল গেমস শিশু, কিশোর ও তরুণদের সামাজিকীকরণে বাধা দেয় এবং এর ফলে মেধা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর কারণে অনেক শিশুর আচরণেও পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। অনলাইন এই গেমস খেলতে বাধা দিলে অনেক কিশোর রাতবিরাতে উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করে, স্বজোরে কথা বলে, পরিবারের সদস্যদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করে এবং তার সামগ্রিক মনোযোগ হয়ে উঠে গেমস কেন্দ্রীক। গেমস খেলতে বাধা দিলে আত্মহত্যার হুমকিও দেয় অনেক কিশোর।

বিশেষজ্ঞের মতে, অধিকাংশ অনলাইন গেমসের কনটেন্ট যুদ্ধ, সংঘাত রক্তপাত নিয়ে। যা কোমলমতি ও মুক্তপ্রাণ শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দিকে এই গেমস শুধু শহর কিংবা নগরের শিশু কিশোরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা মফস্বল শহর এমনকি দেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের শিশু-কিশোররাও এই গেমসে আসক্তি হয়ে পড়ছে। মোবাইল বা কম্পিউটারে তরুণরা ‘পাবজি’র বা ফ্রি ফায়ারের মতো ভিডিওতে এতটাই মগ্ন থাকছে যে, বাস্তব পৃথিবী ভুলে তারা এক বিপজ্জনক নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। কেউ একা কিংবা দলবেঁধে এই গেমস খেলছে। এসব গেমসে আসক্তির কারণে কিশোররা পারিবারিক, সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সচেতন সব মহলই উদ্বিগ্ন শিশু-কিশোরদের নিয়ে।

মনোবিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংঘটিত অনলাইন গেমের নাম দিয়েছে ‘ডিজিটাল মাদক’। আর ভিডিও গেমে আসক্তির জন্য সৃষ্ট মানসিক সমস্যাকে বলা হচ্ছে গেমিং ডিজঅর্ডার। এই ডিজিটাল মাদক কিংবা গেমিং ডিজঅর্ডার এর কারণে আমাদের সন্তানেররা এখন আর খেলার মাঠে যায় না, করে না সংস্কৃতির চর্চা। মা বাবা, ভাই বোন, ঘর বাড়ি, সমাজ তথা দেশ কোন কিছুই গেমিং ডিজঅর্ডার এই কিশোর তরুণদের কাছে ভালো লাগে না। মোবাইল গেমস তাদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তাই তো একজন বিতার্কিক হিসেবে বিতর্কের ভাষায় বলছি, ‘ বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ-অনুভুতিগুলো।’

আমরা উদ্বিগ্ন আমাদের তরুণ প্রজন্ম নিয়ে। আমাদের অসহায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। অধিক সচেতন হতে হবে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে পাবজি ও ফ্রি ফায়ারের মত তরুণ প্রজন্মের জীবন ধ্বংসকারী মরণব্যাধি এই খেলা গুলো আমাদের দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। শিশু কিশোরদের মেধা বিকাশে হুমকি হয়ে পড়া এই মোবাইল গেমসের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে করে তুলতে হবে সচেতন। মোবাইল গেমস যে মাদক, হিরোইন ও ফেন্সিডিলের নেশা থেকে কোন অংশই কম না তা এই নতুন প্রজন্মকে বুঝাতে হবে।

লেখাটি শেষ করতে চাই দেশের সকল বিবেকবান মানুষের কাছে একটি অনুরোধ জানিয়ে। আমার বিনীত অনুরোধ, এই মোবাইল গেমসের বিরুদ্ধে আপনারা আপনাদের অবস্থান থেকে একটি সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সভা সমিতিতে এর কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার গড়ে তুলুন। দেশের প্রতিটি মসজিদে খুতবার সময় এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ইমামদের অনুরোধ করুন। প্রতিটি ওয়ার্ড মেম্বার থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সভা সেমিনার করুন।

একটি পরিপূর্ণ জাগ্রত ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন। আর সময় নেই। দেশ এবং জাতির স্বার্থেই এই সামাজিক আন্দোলন আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। মোবাইল গেমসের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন এখন এবং এখনি শুরু করতে হবে।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক,দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা।ফোন :০১৭১১-৩৮৮৩০৮,

e-mail,  sahajadaamran@yahoo.com.