সমাজের অন্যায্য বাস্তবতা ও পরিণতির অংশ ‘কিশোর গ্যাং’

আলী আকবর মাসুম
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

বাংলাদেশে কিশোর ও তরুণ বয়সীদের জীবনাচার নিয়ে পরিবার ও সমাজে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা যেমন বেড়েছে-তারসঙ্গে তাদের ঘিরে বেড়েছে দেশের সুন্দর, সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মাণে অনেক আশা ভরসাও । সরকার, প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজ ও দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে নেতৃত্বের উপযুক্ত গুণাবলি এবং সততা ও নিষ্ঠার বড় ধরণের অভাবের কথা স্বীকার করেই প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে- কিশোর, তরুণদের ভবিষ্যত নেতৃত্বের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা ছাড়া দেশের আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয় । আবার কিশোর, তরুণদের জীবনের সুগঠনের পথে একাংশের অবহেলা ও উদাসীনতার অতিমাত্রার সঙ্গে প্রযুক্তির আসক্তি বা মাদকাসক্তির মতো বিপথগামীতায় সমাজ,পরিবারে অশান্তি, অস্থিরতা বৃদ্বির কারণে তৈরি হয়েছে অনেক উদ্বেগ, উৎকন্ঠা । কূরুচিপূর্ণ বিনোদনের প্রতি আকর্ষন, মোবাইল গেমস নামের জুয়ায় আকৃষ্ট, এমন কিছুও অসংখ্য জীবনের সুস্থ মানসিক ও মনবৃত্তি গঠনে বড় বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠছে প্রযুক্তির সহজলভ্য অপব্যবহার এবং পরিবার বিমুখতা ও অবাধ্যতার কারণ গুলো। রাজনীতিক অপকান্ড ও নির্বাচনী অনিয়মে ব্যবহৃত তরুণ, যুবরা সুপথ হারাছেন মোহ ও লালসায় পড়ে। এ অবস্থায় সমাজ ও দেশের ভবিষ্যত সম্ভাবনা, সমৃদ্বির গুরুত্ব দিয়ে একদিকে করণীয় নির্ধারণ করা যেমন জরুরি, অন্যদিকে পরিহার, সংশোধন, সংস্কারের মতো যেখানে যা কিছু করা দরকার তারজন্যও সবকিছু করা ছাড়া তার সহজ কোনো সমাধান নেই । এক প্রজন্মের পর পরের প্রজন্ম, ধারাবাহিক ভাবে প্রত্যেকটি প্রজন্মকে সঠিক ধারায় সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথে এগিয়ে নিতে যেখানে যার যেটুকু দায়িত্ব রয়েছে তাও নিতে হবে প্রত্যেককে। এক্ষেত্রে দেশ ও সরকারের জায়গা থেকে যেমন সার্বিক ভাবে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনি সমাজ ও পরিবারের দিক থেকেও রাখতে হবে যথাযথ ভূমিকা। কেননা ‘কিশোর গ্যাং’ অথবা তারুণ্যের উশৃংঙ্খলতা, এমন কোনো উপাদি বা আখ্যা দিয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা এবং বিচ্যুতির দিক গুলোকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় বলে ভাবা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। বরং বলা যায় সমাজ জীবনের অন্যায্য বাস্তবতা ও পরিণতির একটি অংশ হচ্ছে, ‘কিশোর গ্যাং’। আজ বয়সে যে কিশোর, সে তারুণ্য পেরিয়ে একদিন হয়ে ওঠেন একজন সক্ষম যুবক, তারপর কর্মক্ষম থাকা পর্যন্ত থাকেন সম্পূর্ণ ও সক্ষম মানুষ হয়েও। মানুষ গড়ার এমন কাজটি খুব সহজ কিছু নয় বলে তার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় ভুল যা কিছু আছে তার সবকিছু শুধরে নেওয়ার চেষ্টার সঙ্গে অবশ্যই নিতে হবে জীবনে হতাশা, অনিশ্চয়তার নিরসনে সব রকম প্রচেষ্টা । তারসঙ্গে কিশোর, তরুণ বা যে কারো অপরাধ ও অপকান্ডের ক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেও হতে হবে পক্ষপাতহীন এবং অনেক কঠোর। আর তা না হলে হতাশা আর অন্বকারাছন্ন এমন প্রতিটি কিশোর, তরুণের জীবনের সঙ্গে একসময় হারিয়ে যেতে পারে দেশের সুগঠন, সমৃদ্বির সম্ভাবনা ও স্বপ্নও ।
দেশ ও মানুষের এগিয়ে যাওয়ার বাহিৃক ধারনায় গত তিন দশকে নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতের সংখ্যা দেশে যে হারে বেড়েছে তাতে আমাদের স্বপ্ন ও সামর্থ্যরে সীমানাকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ, ব্যবসা-বানিজ্য বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেশের অসামান্য সব সাফল্যের সঙ্গে অর্থনীতিক উন্নতি সবাইকে আরো বেশি আশাবাদি ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে । তবে বাহিৃক ধারনায় এমন সব কিছুকে দেশের উন্নয়ন ও উন্নতির একটি বর্ণিল চিত্র রূপে দেখা গেলেও তার ভেতরে ও পরে আরও গভীরে দিনে দিনে বড় থেকে অনেক বড় ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে । কেননা দেশ ও মানুষকে বাহির দিক থেকে সাঁজাতে, গোছাতে যত বেশি, যত দ্রুত যা যা করা হয়েছে তার তুলনায় ভেতরের পরিচ্ছন্ন, পরিপক্ক দিকটি তৈরিতে ততটাই অবহেলা ও উদাসীনতা দেখানো হয়েছে । ফলে একেবারে সরাসরি ভাবে বললে একথা বলাই যায়, দেশের ভেতরের অবস্থা যেমন খুব ভালো নেই, আবার কিশোর-তরুণরা সহ সব বয়সী মানুষের একটি বড় অংশ বিচ্যুতি ও বিপথগামী পথে জীবনের মনগড়া অর্থে নিজেকে দেখছে কেবল নিজেরই মতো করে । শিক্ষা, ঐতিহ্য, সভ্যতার সম্মিলিত অর্থ মিলে হচ্ছে-আমাদের সংস্কৃতির গৌরবের পরিচয়, যা অটুট রাখার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বকিয়তা রক্ষা করে সমৃদ্ধির পথে এগোবার পথ দেখায় । কিন্ত যখন অর্থনীতিক ব্যবস্থায় অন্যায় ও অন্যায্য আর্থিক উন্নতি কেন্দ্রিক দিক থেকে সমৃদ্ধির অসম্পূর্ণ ধারণা বড় হয়ে উঠে তখন দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মানুষের মানবিক জীবনের গুরুত্ব অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায় । আমাদের দেশে হয়তো সেদিকেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে বলে ক্ষতির যা কিছু হচ্ছে তার মধ্যে কিশোর,তরুণদের সুন্দর ভবিষ্যত এবং তাদের সুগঠনের গুরুত্বের বিষয়টিও বিচ্ছিন্ন ভাবে বিবেচিত হচ্ছে । দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের দিকে সরকারের নীতিগত অবস্থান এবং দেশী, বিদেশি বেসরকারি কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক মুনাফা ও দ্রুত প্রতিষ্ঠার সুযোগ নিতে গিয়ে এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও ভ্রান্ত ধারণার দিক গুলোও ইতিবাচক অর্থে স্বীকৃত হয়ে যাচ্ছে। তার ফলে নানা ভাবে কিশোর, তরুণ সহ দেশের অধিকাংশ মানুষ বৈধ-অবৈধ, নৈতিক-অনৈতিক এমন সব বিবেচনা বাদ দিয়ে কেবল অর্থ, সম্পদ অর্জন দ্বারা জীবনের মূল্য, মর্যাদা নির্ধারণের বিশ্বাসের দিকে সম্পূর্ণ ভাবে ঝুকে পড়েছেন । তাতে অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল্য, মানুষ ও মানবিকতা, বা ন্যায়,অন্যায় বোধের সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের মতো অতি অপরিহার্যতা গুলোও যেন ক্রমশ কেবলই কথার কথায় পরিণত হচ্ছে ।
মুক্ত বাজার অর্থনীতিক ব্যবস্থার নামে আমাদের দেশে সরকারের নীতিগত অবস্থান ও ভূমিকার ফলে বেসরকারি খাতে ব্যবসা, বাণিজ্যের বিকাশে এক অস্বাভাবিক গতি তৈরি হয়েছে । তাতে যেমন অর্থনীতিক কর্মকান্ড অনেকটা নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে চলছে, আবার দেশে নিয়ম,নীতির বাইরে বড় পরিসরে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবাদি শ্রেনির উত্থানও হয়েছে । প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এই উভয় দিকে অর্থ আয় ও অর্থ আয়ের ক্ষেত্র নির্ধারণে ন্যায্য,অন্যায্য এবং বৈধ, অবৈধতার বিচারের গুরুত্ব প্রধান বিবেচ্য বিষয় না হয়ে যে কোনো মাধ্যম বা উপায়ে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়া কিংবা অর্থের আদান-প্রদান বৃদ্ধির হিসাবই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে । বর্তমান অর্থনীতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশের ধনীক শ্রেনির স্বার্থ রক্ষায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় অর্থের লুন্ঠন রোধ ও গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়েছে। বছরে মাদক কারবারের শত শত কোটি কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির দেওয়া, নেওয়ার মতো হাজার কোটি টাকার যে কোনো অর্থের লেনদেনও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির নামে বিবেচিত হচ্ছে। শুধু ঢাকার ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজির চাঁদার পরিমান মাসে একশত আশি কোটির টাকার হিসাব ওঠে আসছে সংবাদ পত্রের পাতায়। এভাবে দেশের এক শ্রেণির ব্যাক্তিরা যেমন এক্ষেত্রে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন, তেমনি বৈধ, অবৈধ অথবা নিয়ম, অনিয়মের বিষয়টিও অনেকটা সমান বিবেচনার ধারণায় যার যেমন সুবিধা তেমন ভাবে ব্যবসা বা অর্থ আয়ের উৎস হয়ে যাচ্ছে । আঠার বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে পর্যন্ত মোবাইল ফোন, কম্পিউটার তুলে দেওয়ার ফলে প্রযুক্তির আশ্রয়ে নগ্নতা ও নেশার সমান নানা অপকর্মে আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের অসংখ্য কিশোর ও তরুণ । কোনো রকম বাছবিচার এবং সীমাহীনতার কোনো সীমা না রেখে মোবাইল ফোনের অবাধ ব্যবহার শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার সময়ের অত্যাধিক অপচয় বাড়িয়েছে শুধু তাই নয়, কমিয়েছে আপন সান্নিধ্যের সুযোগ এবং সর্ম্পকের মাঝে তৈরি করেছে অন্যায্য চাহিদা ও অবাধ্যতার ব্যাধি। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ও পুঁজিবাদি ধারণায় দেশে এসিআই, প্রাণ অথবা বসুন্ধরা শিল্প গোষ্ঠির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান মুড়ি, চানাচুর, লবন, আটা যেমন বাজারে বিক্রি করছে, আবার রড, সিমেন্ট, ওষুধ, আবাসন শিল্পের বৃহৎ পুঁজির ব্যবসাও তারাই করছে । অথচ বেকারত্ব দূর বা কর্মসংস্থানের জন্য যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চান কিংবা কোনো ভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে এগিয়ে যান তাদের মধ্যেও অর্থ সহায়তার অভাব ও বড় ব্যবসায়ীদের দাপটে অনেকে মাঝ পথে এসে থেমে যান, অথবা একেবারে হেরেও যান । আর যারা তার কোনোটাই করেন না তারা ভেজাল খাদ্য, নকল ভোগ্য পণ্যের ব্যবসা, প্রতারণা মূলক কোনো ফাঁদ, রাজনীতির অনিয়মে বাণিজ্য, পণ্য বিবেচনায় শিক্ষা, চিকিৎসার নামে ব্যবসা- এমন যে কোনো উপায়ে প্রতিষ্ঠিত হবার পথ বেছে নেন। আবার সাধারণ মধ্য, নিম্মবিত্তের তরুণ, যুবকদের যারা উপরে ওঠা লোকদের সুখ-ভোগের দৃশ্য দেখেন, দেখেন নিজ পরিবারের অসহায়ত্ব আর অর্থ কষ্ট- কিন্ত নিজেদের এগোবার কোনো পথ দেখেন না, তাদের মধ্যে অনেকে একসময় অন্যায়, অপরাধের পথে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া ও বিপথগামী। তরুণ ও যুবদের মাঝে মানসিক শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন তার সংখ্যাও আরও বেড়েছে । এমন সব কিছুই এখন যখন আমাদের চারদিকের বাস্তবতা- তখন কিশোর, তরুণরা কতটা কেমন বোধ, বিবেচনা, উপলদ্ধি নিয়ে বয়সে ও জীবনে বড় হচ্ছেন বা হতে পারেন, তার বিচার-বিবেচনার দিকটি আজও অসম্পূর্ণ ও অনৈতিক ধারনার উপর দাঁড়িয়ে আছে । তাতে তাদের নিয়ে আশা, ভরসার যেটুকু যা আছে তাই নিয়ে একরকম সান্ত্বনা খুঁজে পেলেও সত্যিকার সুগঠনের চেষ্টায় করণীয় অনেক কাজই করা হচ্ছে না। আবার তারুণ্যের উশৃংঙ্খলতা অথবা ‘কিশোর গ্যাং’ আখ্যা দিয়ে বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখলে সমস্যার সমাধান বা ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন আসার কথা নয়। কিশোর, তরুণ, যুবদের দেশ ও সমাজের ভবিষ্যত উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সমাজ- রাজনীতিতে ক্ষমতায়নের নীতির সংস্কার এবং অর্থনীতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নেতিবাচক অবস্থার পরিবর্তন খুব দরকার। তারসঙ্গে লোভ- লালসা পূর্ণ বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে জীবনের সুগঠন ও সুশিক্ষার চর্চার জাগ্ররণ প্রয়োজন আরও অনেক বেশি।
আলী আকবর মাসুম, মানবাধিকার বিষয়ক পরামর্শ, কুমিল্লা।