রুবেল মজুমদার ।।
কুমিল্লা জেলায় এবার বেশ কয়েকটি উপজেলায় তেলবীজ হিসেবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্বল্প ব্যয়ে লাভজনক হওয়ায় সূর্যমুখী চাষে জেলার বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে গত বছরের তুলনা দ্বি-গুণ। এবার কমিল্লা জেলার হোমনা, দেবিদ্বার, সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় পরীক্ষারমূলকভাবে কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জেলার প্রায় ১৫ টি স্থানে সূর্যমুখী আবাদ করা হয়েছে। কৃষকরা সাফল্য পাওয়ায় অন্যান্য কৃষকরা সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকে পড়ছে।
সকাল গড়িয়ে বিকাল হলো। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা গলিয়ারা গ্রাম, গ্রামটি সীমান্তবর্তী এলাকা হলেও মনে হয় যেন কৃষিনির্ভর উত্তরবঙ্গের একটি প্রচীনতম সুন্দর গ্রাম। মৃদু রোদে দূর থেকে মনে হয় এ যেন এক সূর্যের মেলা। হাজার হাজার ফুটন্ত সূর্যমুখী তাকিয়ে আছে সূর্যের দিকে। গ্রাম জুড়ে আর এমন এক বৈচিত্র দেখতে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে দর্শনার্থীরা। ফুল ফুটেছে তার যৌবনে। এ যেন সবুজের মাঝে হলুদের সমাহারের মতো। কেন জানি সূর্যের ঝলকানিতে হলুদ রঙে ঝলমল করছে চারপাশ। পুরো এলাকায়জুড়ে বইছে সূর্যমুখী সু-বাতাস।
গলিয়ার গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম। প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী চাষের জন্য প্রতিবেশী চাচার থেকে বর্গা অনাবাদি জমি নিয়ে ফুল চাষ করেন। ইতোমধ্যেই জেলাজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা গ্রামের এই কৃষক। গতবছর জমিতে মৌসুমি সবজি চাষ করে লাভবান না হাওয়া এবার ঝুঁকি নিয়ে একটি এনজিও সংস্থা থেকে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রায় ৬০ একর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেন ।
তিনি বলেন ,উপজেলার কৃষি অফিস বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ এবং পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন। পরীক্ষামূলক জাত ‘বারি সূর্যমূখী’-৩’র ব্লক,হাইসান-৩ ব্লক, বারি সূর্যমুখী-২০ জাত চাষ করি। করোনার প্রভাবে গত বছর আমাগো সবজি ব্যবসা লাভ হয় নাই। তাই কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এবার সূর্যমুখী চাষের সিন্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি আমার পুঁজি দশ হাজার হলে এক লক্ষ টাকার সূর্যমুখীর তেল বিক্রি করতো পারবো ।
এছাড়া চৌদ্দগ্রাম, হোমনা, দেবিদ্বার উপজেলার বিভিন্ন সূর্যমুখী প্রদর্শনী প্লটে গিয়ে দেখা যায়, ফুটে থাকা হলুদ সূর্যমুখী ফুলের সমাহারে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। চারদিকে হলুদ রঙের ফুলের মনমাতানো ঘ্রাণ আর মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে কৃষকের জমি। এটি যেন ফসলি জমি নয়, এ এক দৃষ্টিনন্দন বাগান। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকনে শুধু প্রকৃতি প্রেমীই নয় বরং যে কারো হৃদয় কাড়বে। তবে সূর্যমুখী ফুল চাষের লক্ষ্য নিছক বিনোদন নয়। মূলত ভোজ্য তেল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা মেটাতে এ চাষ করা হচ্ছে। তেল জাতীয় অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখীর চাষ অনেক সহজলভ্য ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকেরা এতে উৎসাহিত হয়ে উঠেবেন বলে কৃষি অধিদপ্তর মনে করছে।
স্থানীয় কয়েকজন সূর্যমুখীর চাষিরা জানান, অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে জমিতে সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন করা হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ৩ কেজি বীজ, সামান্য পরিমাণ রাসায়নিক সার ও দু’বার সেচ দিতে হয় এ ফসলে। সবকিছু মিলিয়ে প্রতি বিঘায় খরচ হয় প্রায় ২-৩ হাজার টাকা। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘায় ১০-১২ মণ তৈল বিজ হয়। সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যয়। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, উৎপাদিত সূর্যমুখী বীজ বাজারে ১৪০০-১৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করা যাবে। আর তা থেকে একজন কৃষকের খরচ বাদে লাভ হবে বিঘায় ১৪০০০-১৫০০০ টাকা।
দেবিদ্বার উপজেলার কৃষক আবু তাহের মিয়ার জানান, কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এক একর জমিতে সূর্যমূখী চাষের পরিকল্পনা নিই। আমি আমার জমির সাথে আরো ৪৫ শতাংশ জমি ২০ হাজার টাকায় পত্তনে রাখি। কৃষি বিভাগ আমাকে বীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ এবং পরামর্শ দিয়ে পরীক্ষামূলক জাত ‘বারি সূর্যমূখী’-৩’র ব্লক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। শুধুমাত্র জমি, শ্রম এবং উৎপাদিত ফসল আমার। বাকি সব দেখভাল ও খরচ তাদের। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর সূর্যমুখীর আবাদ করি। চলতি মার্চ মাসের শেষ দিকে ঘরে তুলব।
হোমনার কৃষক ওয়ালিদ সরকার জানান, ৭৭ শতাংশ জমিতে তিনি প্রথমবারের মতো সুর্যমূখী ফুলের চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়েছে। তিনি আরো জানান, তার সবমিলিয়ে বিনিয়োগ হয়েছে ২১ হাজার টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে সূর্যমুখীর তেল বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা মুনাফা হবে বলে।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ভারপ্রাপ্ত) উপ-পরিচালক শহিদুল হক বলেন, প্রথমবারের মতো কুমিল্লা জেলায় ১শ ৩৩ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে কৃষকদেরকে সার,বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। আমরা আগামী বছর ৩ শত হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। সূর্যমুখী ভোজ্য তেল হিসেবে গুণগতমান ভালো থাকাই দেশ ও বিদেশে এর চাহিদা । বাজারে সূর্যমুখীর চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় চাষিদের হাসি ফুটবে বলে আমি মনে করি । সূর্যমুখীর চাষের জন্য কৃষকদের আগ্রহ করতে আমরা উপজেলা পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছি।
Discussion about this post