দেশটা হয়েছে আমাদের, আমরা কতটা হয়েছি দেশের

আলী আকবর মাসুম
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

আমরা কবে হব-দেশের । এমন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা আমাদের কারো দিক থেকে আছে কী নেই, তার সব প্রমান একসঙ্গে মিলাতে না পারলেও বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে আজ পর্যন্ত আমরা কতটা দেশের হতে পেরেছি । বাংলাদেশটা হয়েছে আমাদের, আমরা কবে হব-দেশের, এই প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার মর্ম দুই ভাবে দেখলে ও যে কেউ যে কোনো একটির দিক থেকে তাঁর নিজের উত্তর খুঁজলে হয়তো দেখতে পাব, আমরা অনেকে নিজেকে কথায়-কর্মে সঠিক স্থানে খুঁজে পাচ্ছি না । ব্যক্তি থেকে সমষ্টি কিংবা অনেকের ক্ষেত্রে যখন দেশের নাগরিক ও মানুষ হিসেবে সঠিক অবস্থান বজায় থাকে না, তখন আসলে দেশের যে কোনো ব্যবস্থাও সঠিক নিয়ম-নীতির অনুসরণে চলছে বা চলবে তার আশা করা না করার মাঝে কোনো পার্থক্য আর থাকে না। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে পদ-পদবী ও দায়িত্বে আছেন এমন ব্যক্তি বা সমষ্টির ন্যায়-নিষ্ঠা, বোধ-বিবেচনার অভাব যখন যে কোনো ব্যবস্থাকে একে একে ‘বিনষ্ট’ করে দেয় তখন সেই ব্যবস্থাকে সঠিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের পরিবর্তনও ব্যবস্থা বদলের উপর নির্ভর হয়ে যায় । অর্থাৎ অনিয়ম, দুর্নীতি, অন্যায্যতার কারণে দেশের প্রতিটি ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় যেরকম ক্ষতি, অবনতি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হয়েছে তা থেকে উত্তরণে সংস্কার কিংবা পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। দেশের আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে, হয়েছে অনেক উন্নয়নও। কিন্তু তারসঙ্গে বাংলাদেশের শাসন প্রশাসন ও দেশ পরিচালনার প্রতিটি পর্যায়ে যেরকম সামর্থ্য, সক্ষমতার কথা বলা হয়, তার বিপরীতে ততটা সুফল ও কল্যানকর সবকিছু দেশ ও দেশের জনগণ পেয়েছে বা পাচ্ছে একথা বলার সুযোগ নেই। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের শান্তি,উন্নতি, স্থিতিশীলতার চেয়েও রাজনীতিতে শাসন ক্ষমতা রক্ষা অথবা ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনীতির লড়াই যখন একমাত্র মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন দেশ প্রেমের দোহাই শুধুই কথার কথা হয়ে যায়। দেশের রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞজনদের মুখেই যখন শুনি, দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব কেবলই বেড়েছে তখন দেশের শাসন, প্রশাসন সহ জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক ব্যবস্থা কতটা সঠিক ভাবে চলছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । ধনীক শ্রেণি ও গোষ্ঠি স্বার্থ রক্ষার মতো বৈষম্য মূলক অর্থনীতিক ব্যবস্থা যে, দেশ ও মানুষের স্বার্থ বিরোধী তৎপরতাও বাড়ায় তার প্রমান এখন শুধু ব্যবসায় সিন্ডিকেট, দুর্নীতির ভয়াবহ রুপ, বিদেশে অর্থ পাচার বা ব্যাংক ঋনের টাকা আত্মসাতের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই । ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে আর্থিক অবস্থান ও রাজনীতিক বিবেচনা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে বলে মানুষ মানুষে সম্পর্ক এবং মর্যাদার সহাবস্থানের চেয়ে বিভক্তি ও ভেদাভেদের মুখে পড়েছে পুরো সমাজ ব্যবস্থা । সংস্কৃতিবোধ ও সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চার অবনমনে সমাজ জীবনে সভ্যতার পথ, পরিচয়ও ক্রমেই খাট হচ্ছে।
রাজনীতিতে বাম বা ডান পন্থী বিশেষণের কথা শুনেছি প্রথম কলেজে পড়ার সময় থেকে । ‘বাম পন্থী’ মানে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের কল্যানের পক্ষে রাজনীতি, আর পূঁজিবাদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনীতির ধারণাকে ‘ডান পন্থী’ হিসেবে বলা হত । বৈশ্বিক রাজনীতির একসময়ের অবস্থার অনুসরণে আমাদের রাজনীতিতে তার রীতি, নীতির একরকম প্রভাব থাকলেও তা নিয়ে বিরোধ ও বিভ্রান্তির শেষ কখনোই হয়নি । তারসঙ্গে দেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অবদান থাকার পরও বলা যায় রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের চিন্তা, চেতনার মাঝে অসম্পূর্ণতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব থেকেই গেছে । স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে দেশে কোন পন্থার রাজনীতি আদর্শগত দিক ও সক্ষমতায় শক্তিশালী হয়েছে কিংবা দেশ ও মানুষ রাজনীতির সুফল কতটা পেয়েছে-এমন জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে বাস্তবে তার পরিচয়, প্রমান আজও খুব বেশি কিছু নয় । স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে স্বপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সুচনা হয়, তারপর থেকে রাজনীতির সঠিক গতিপথ আর ফিরে আসেনি । ফলে এ পর্যন্ত দলগত কার্যক্রম ও দলীয় আদর্শের দিকটি যতটা যেভাবে প্রচার ও প্রকাশ করা হয় তারসঙ্গে বাস্তবে রাজনীতির খুব একটা মিল নেই বললেই চলে । রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হলেও সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনায় সরকার ও বিরোধী দল গুলোর মাঝে সহাবস্থান এবং সুষ্টু নির্বাচন নিয়ে আস্থার সংকটে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সব প্রয়াসই যেন থমকে আছে। বড় প্রধান দুটি রাজনীতিক দল তাদের অন্য সমমনা দল গুলোকে সঙ্গে নিয়ে একাধিকবার সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করলেও দল, রাজনীতি তথা দেশ ও দেশের মানুষের মৌলিক এবং গুণগত পরিবর্তন ও উন্নয়ন কতটা হয়েছে তাও দলীয় বিবেচনার বাইরে সবার কাছে গ্রহনীয় মাত্রায় নেই । বিগত তিন দশকের মাঝে যারা কিশোর, তরুণ বয়স পার করেছেন সেই কয়েক প্রজন্ম সমাজ-রাজনীতি, শিক্ষা-কর্ম ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নেতিবাচক যা যা প্রত্যক্ষ করেছে ও তার যা কিছু চিন্তা, চেতনায় গ্রহণ করেছে তাতে এসবের চেয়ে ভালো কিছু হয় বা হতে পারে তা যেন তাঁদের চিন্তাতেও নেই । দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা রাজনীতির মাঠের ছাত্র-যুবরা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে রোধ, প্রতিরোধ করতে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার এবং যেভাবে সংঘাত, সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন, তাতে রাজনীতির নামে এমন অপকান্ড আর কোনো দেশে এতটা আছে বলে বলা যায় না । স্কুল, কলেজ গুলোতে শৃঙ্খলা ও ক্লাস রুমের নিয়ম মাফিক লেখাপড়ায় অনেক বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সেই সাথে শিক্ষা কার্যক্রমে অস্বাভাবিক ব্যয় ও বানিজ্যিক স্বার্থের প্রাধান্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং শিক্ষার গুণগত দিক ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে । তারপর আবার বেকারত্ব, কর্ম সংস্থানের অনিশ্চয়তা সহ ঘুষ-দুর্নীতি প্রবন পরিস্থিতিতে সর্বত্র নীতি বর্জিত মানসিকতা যেভাবে বড় হয়ে ওঠেছে তাতে জীবনের শুরু থেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগও আর কতটা থাকে । অর্থাৎ সাধারণ দৃষ্টির বাইরে গভীর ভাবে দেখলে খুব সহজেই বুঝা যায়-প্রতিষ্ঠান, পরিবার বা সমাজ থেকে মানুষ হিসেবে সুগঠনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে ভুল পথ,পন্থা ও প্রতিকূলতা। রাজনীতি ও অর্থনীতি ধনীক শ্রেণির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্য, ব্যবধান তৈরির মতো অর্থনীতিক ব্যবস্থা দেশের নেতৃত্ব, কর্তৃত্বের প্রতিটি পর্যায়েও অন্যায্য স্বার্থপরতাকে বড় করে তুলেছে।
পরাধীনতার গ্লানি এবং নিপীড়ন ও বৈষম্য মূলক শাসন থেকে মুক্তির জন্যই অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই থেকে এই দেশটি আমাদের হয়েছে। তারপর দেশের সংবিধান প্রণয়ন ও তার অনুসরণে রাষ্ট্র কাঠামো, সরকার ব্যবস্থার নিয়ম-নীতিও নির্দিষ্ট হয়েছে। এভাবে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের যাত্রা শুরু হলেও দারিদ্র্যতা ও অধীক সংখ্যক অশিক্ষিত মানুষের এই দেশের এগোবার পথটা সহজ ছিল না । কিন্তু ফল-ফসল উৎপাদনে ছিল উর্বর মাটি ও পর্যাপ্ত কৃষি জমি, ফলন উৎপাদনে কিষাণ-কিষাণির ছিল আন্তরিক উদ্যোগ ও অদম্য শক্তি, ছিল খাল-বিল, জল-জলাশয়, পুকুর-নদী ভরা মৎস সম্পদ, প্রকৃতির নানা রকম দান-অবদানের সঙ্গে ছিল দূষণ মুক্ত সুন্দর, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আর আজ পর্যন্ত আছে শ্রমজীবী মানুষের কঠিন পরিশ্রম ও কষ্টের অনেক সাফল্য । যার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যতা হ্রাস, শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুযোগ, সুবিধা দিনে দিনে বেড়েছে। যদিও বাড়েনি কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের জীবনমান ও প্রাপ্য মর্যাদা। তাসত্ত্বেও সরকারি ও সরকারি অনুমোদনে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং তার কার্যক্রমের দায়িত্বে যারা আছেন তাঁদের কজন আছেন যে, দেশ ও মানুষের প্রয়োজনীয়তার দাবি পূরণে সততা-নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে থাকেন । আর তা যথার্থ অর্থে নেই বলেই দেশে ন্যায় বিচার ও সুশাসনের অভাব এবং গনতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার সংকট থেকে উত্তরণের পথে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি । দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার ও চাহিদার দাবি গুলো পূরণে দৃশ্যতঃ প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম থাকলেও তার ভেতরের মানুষ ও পরিচালন ব্যবস্থায় ন্যায়, নিষ্ঠা এবং সক্ষমতার অভাব কাটছেই না । দেশের অফিস, আদালত ও সেবা, সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব প্রাপ্তদের অনেকের আপন স্বার্থ যেভাবে যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, তাতে দেশ ও মানুষের স্বার্থ ততটাই উপেক্ষিত হয়েছে । অন্যভাবে বললে, আমরা যতটা হয়েছি আমার -ততটা হতে পারিনি আমাদের। একইভাবে এই দেশটা শুধুই হয়েছে আমাদের, কিন্তু আমরা কতটা হতে পেরেছি দেশের, তা হয়তো জানার মাঝেও অজানাই থেকে যাবে। বিজয়ের মাসে যে কারো এমন আক্ষেপ কিংবা মুক্তির আশা করা অস্বাভাবিক নয়।