‘অন্ত:সত্ত্বা নারীকে ধর্ষণের সহায়তা করায় রাজাকারকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করি’-জাহিদ হাসান

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -১৬
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :

বীরমুক্তিযোদ্ধা জাহিদ হাসান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ২৫ মার্চ রাতে যখন হানাদার বাহিনী কুমিল্লা শহরে আক্রমণ করার পর আমরা মূল নেতৃত্ব থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। সারা শহরে পাকিস্তান আর্মির টহল বেড়ে যায়। এই অবস্থায় ২৯ মার্চ গ্রামের বাড়ি কসবার রায়তলা গ্রামে চলে যাই। গ্রামে গিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি আমাদের ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র নেতাদের সাথে। তারা তখন কে কোথায় আছেন কিছুই জানি না। এপ্রিলে সম্ভবত দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে হঠাৎ এক সকালে দেখি আমাদের গ্রামের ঈদগায়ে বঙ্গবন্ধু ছেলে শেখ জামাল। আমাদের এলাকার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ময়নাল হোসেন মনা ভাই তাকে দেখভাল করে ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শেখ জামালকে আমাদের গ্রামে দেখে আমার যুদ্ধে যাওয়ার উদ্দীপনা আরো বেড়ে গেল। কিন্তু যাব কিভাবে ? কারণ,আমি হলাম বাবা-মার সবচেয়ে ছোট ছেলে। তার উপর বাবা নেই। বলতে পারেন মায়ের অন্ধের যষ্টি আমি । কুমিল্লা শহর থেকে গ্রামে আসার পর মা আমাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছেন। যাতে আমি কোন ভাবেই যুদ্ধে না যাই। এপ্রিলের শেষ দিকে বা মে মাসের প্রথম দিকে চাচাতো ভাই খসরুসহ মাকে না বলে নৌকা দিয়ে যাই কসবা সীমান্তে । পড়ে এখান থেকে ভারতের আগড়তলা হাফানিয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে যাই।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
আগড়তলা হাফানিয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে এসে আমাদের বি বাড়িয়ার প্রভাবশালী ছাত্র নেতা কুতুব ভাই, হুমায়ুনসহ আরো অনেকের সাথে দেখা হয়। এখানে কয়েকদিন থাকার পর যখন দেখি প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা হচেছ না তখন যাই কংগ্রেস ভবনে। সেখানে অধ্যাপক খোরশেদ আলম স্যারকে পেয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষনের কথা বলি । বললেন, আচ্ছা দেখতেছি কি করা যায়। কিছু দিন পর আমাদের ইয়ুথ ক্যাম্পে আসেন খোরশেদ স্যার, ছাত্রনেতা ও পরবর্তী পর্যায়ে মন্ত্রী এমপি শাহজাহান সিরাজ, ভিপি শাহআলম ভাই ও কুতুব ভাই । তারা আমাকেসহ প্রায় ৪০/৫০জনকে প্রশিক্ষণের জন্য হাফানিয়া ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে প্রথমে নিয়ে যায় লোহারভর প্রশিক্ষণ শিবিরে।এখানে প্রশিক্ষণের সুযোগ না পেয়ে আমাদের ওম্পিনগর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যায়। এই ওম্পিনগর কেন্দ্রের মূল দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় মেজর আব্রাহাম। আমাদের চার্লি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ফোর ব্যাংগলের সুবেদার মেজর আম্বর আলী আর প্রশিক্ষক ছিলেন,ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকরা। এক মাস প্রশিক্ষণ শেষ করে আমাদের অস্ত্রের জন্য পাঠানো হয় মেলাঘর ক্যাম্পে। মেলাঘর ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত ও পরবর্তী পর্যায়ে ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দার আমাদের অস্ত্র না দিয়ে অস্ত্র দিচ্ছেন ঢাকা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের। এতে আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়। এরপর একদিন সকালে মেলাঘরে দেখা হয় আমার বন্ধু ও বর্তমান কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল ও ভিপি শাহআলম ভাইয়ের সাথে। আমি কমান্ডার বাবুলকে ঘটনাটি জানালে তিনি সাথে সাথে মেজর হায়দারের কাছে গিয়ে আমার নামে একটি এস এল আর ইস্যূ করান। অস্ত্র দেয়ার পর আমাদের দেওয়া হয় এফ এফ বাহিনীর যুদ্ধকালীন সময়ে কোতয়ালী থানার কমান্ডার আবদুল মতিন ভাইয়ের সাথে। কোতয়ালী ক্যাম্পটি ছিল তখন এনসি নগরে। এই এনসি নগরে এসে পাই বন্ধু আবু, আসাদ, বুলবুল,নাঈম,কমল ও রফিককে।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :
যুদ্ধের অণুগল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহিদ হাসান বলেন, আগস্টের শেষ দিকে হবে। আমাদের কমান্ডার আবদুল মতিন ভাই বললেন, আমরা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবির ইটাল্লা আক্রমন করব। তোমরা দ্রুত প্রস্তুত হয়। কমান্ডার মতিন ভাইয়ের নেতৃত্বে বেলা ১২টার দিকে আমরা ২৫/৩০জন মুক্তিযোদ্ধা ইটাল্লা আসি। আমরা ইটাল্লা গিয়ে সবেমাত্র এ্যামবুশ করলাম। এরই মধ্যে হানাদার বাহিনী আমাদের উপর ফায়ার শুরু করে। আমি ছিলাম কবারিংয়ে। তখন আমাদের প্রথম দল নাজিম উদ্দিনসহ অন্যান্যরা পাল্টা আক্রমন শুরু করে। একপর্যায়ে যখন দেখা গেল হানাদার বাহিনী আর্টিলারী নিক্ষেপ করছে তখন আমি,নঈম,কমলসহ আমরা যারা কভারিংয়ে ছিলাম, তারা সামনে এসে ফায়ার শুরু করি। এ সময় আমার হাতে ছিল একটি এসএলআর। আমাদের যৌথ আক্রমনে পাক সেনারা সেদিনের মতো পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এরপর কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে সুবর্নপুর, আমড়াতলী,শিবের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। স্মরণীয় যুদ্ধের স্মৃতি জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা জাহিদ হাসান বলেন, ঐ সময় প্রতিটি যুদ্ধই ছিল স্মরণীয় যুদ্ধ। তবে সেপ্টম্বর মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে শিবেরবাজার-আমড়াতলী-ছাওয়ালপুর যুদ্ধটি ছিল ভয়ানক যুদ্ধ। আমাদের কাছে খবর ছিল যে ,হানাদার বাহিনী শিবেরবাজার-আমড়াতলী-ছাওয়ালপুর এর দিকে অগ্রসর হচ্ছ্ েআমরা তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আমরাও শিবের বাজারের দিকে আসছ্ ি। এর আগেই আমরা পাক বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমন প্রতিহত করতে এখানে এসে কয়েক দিন অবস্থান নেই।
পাকিস্তান বাহিনী হঠাৎ করে শিবেরবাজার-আমড়াতলী-ছাওয়ালপুর এক সাথে তিন দিক দিয়ে ত্রিমুখী আক্রমন করছে ,আর্টিলারী নিক্ষেপ করছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের সাহায্য চাইলেন। তিনি সাথে সাথে আমাদের তিন প্লাটুন সেনাবাহিনীর সদস্য দিলেন।কিন্তু তারপরেও আমরা তাদের আক্রমনের মুখে দাঁড়াতেই পারছি না। যখন দেখছি তারা শক্তিশালী থেকে আরো শক্তিশালী হয়ে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে আসছে। এই অবস্থায় আমাদের পুরো বাহিনী পেছনের দিকে ছুটে যায়। পরে হানাদার বাহিনী পুরো তিনটি এলাকা দখল করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞা,লুটপাট ও ধর্ষনসহ এমন হেন কাজ নেই যা তারা করে নাই। প্রায় শতাধিকের উপর নিরীহ গ্রামবাসীকে তারা হত্যা করে। এমনকি ১০/১৫জন নারীকে ধর্ষনের পর হত্যা করে প্রায় দেড় বছরের জীবন্ত শিশুসহ একটি রুমে আটকে রেখে বাহির দিয়ে বন্ধ করে দেয়। হানাদার বাহিনী স্মরণ কালের এই নির্মম হত্যা ধর্ষনযজ্ঞের খবর পেয়ে দুই দিন পর আমরা আবার পূর্ন শক্তি নিয়ে নিয়ে আবার শিবেরবাজার-আমড়াতলী-ছাওয়ালপুর আসি।এসে দেখি, একটি বদ্ধ ঘরে ১০/১৫টি মহিলার বিবস্ত্র মৃত দেহ।প্রচন্ড গরমে তীব্র দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এরই মধ্যে পাওয়া গেল প্রায় দেড় বছরের অর্ধমৃত একজন শিশুও।সবাইকে আমরা জানাযা,কাফন,গোসল ছাড়া এক সাথে মাটি চাপা দেই। পরে শুনলাম, হানাদার বাহিনীর একটি পরিত্যক্ত ব্যাংকারে ১৫/১৬ বছরের এক অন্ত:সত্তা যুবতী মেয়েকে ধর্ষন করে আটকে রেখে এক রাজাকারকে পাহারাদার হিসেবে রেখে যায়। যাতে ঐ ধর্ষিত মেয়েটি বের হতে না পারে। আমরা ঐ মেয়েটিকে উদ্ধার করে তার বাবা-মার হাতে হস্তান্তর করি। পরে ঐ রাজাকার (এখন আর নাম মনে নেই)কে ধরে এনে আমার এসএলআর দিয়ে তাকে হত্যা করি। এ সময় আমার বন্ধু নাজিম উদ্দিন,আবু,আসাদসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও সাথে ছিল।

পরিচয় :
জাহিদ হাসান। পিতা মুকবুল হোসেন এবং মাতা জমিলা খাতুন। পিতা মাতার ৪ ছেলে আর ২ মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও বেড়ে উঠেছেন শহর কুমিল্লায়। বর্তমানে এখানেই তিনি স্থায়ী নিবাস করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার চানপুর তমিজ উদ্দিন হাই স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরে ১৯৭০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগের শাহ আলম-কবীর-সেলিম প্যানেলে সহ সমাজ সেবা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই সময়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন এড. সৈয়দ আবদুল্লাহ পিন্টু।