যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক কুমিল্লা শহরে আক্রমনের পর ২৬ মার্চ সকাল থেকে নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে শহর কুমিল্লা। নেতাদের না পেয়ে আমি একাই সিদ্ধান্ত নেই ভারত যাওয়ার। কারণ ভারতের সোনামুড়া রয়েছে আমার বিশাল বন্ধু বাহিনী। তখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতে কোন ক্যাম্প খোলা হয়নি। ২৭ মার্চ সকালে কুমিল্লা পুলিশ লাইনের ৪জন পুলিশকে সাথে নিয়ে কুমিল্লা থেকে রওয়ানা দেই। গোলাবাড়ি সীমান্তে অবস্থিত আবুল হোসেন ভুইয়ার বাড়িতে পুলিশ ৪জনকে রেখে আমি সীমানা পাড় হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া বাজারে যাই। তখন সোনামুড়া ছিল ত্রিপুরার একটি মহাকুমা। সোনামুড়া গিয়ে বন্ধু বাবুল সেন, প্রদীপ সাহা,জহিরুল হক ভুইয়া,তপন চক্রবর্তীকে নিয়ে বিকালে গোলাবাড়িতে ফিরে আসি। পরে রাতেই আবার সোনামুড়া গিয়ে ৪ পুলিশকে জহিরদের বাড়িতে নিয়ে যাই।
পরদিন ২৮ মার্চ সকালে যখন সোনামুড়া ঘুরতে ছিলাম , হঠাৎ দেখি আমাদের এমপি মীর হোসেন চৌধুরী ও এমএলএ আলী আকবর ভাই সোনামুড়ার জলযোগের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাত্র রাজনীতি করার কারনে তারা আমাকে চিনে এবং জানে। আমি তাদের দেখে সালাম দিয়ে জানতে চাইলাম ভাই এখানে যে। তখন মীর হোসেন চৌধুরী বলল, কোথায় যে যাব, তাই ভাবছি। সোনামুড়ার ছাত্র থেকে যুবক অনেক নেতার সাথেই আমার চেনা জানা ছিল। আমি আমার স্থানীয় বন্ধুদের ডেকে বললাম,তারা দুই জন আমাদের দেশের এমপি,বড় নেতা। তখন সাথে সাথে বন্ধু জহির থানার ওসিকে ফোন করে বিষয়টি জানালে তিনি তাদের থানায় নিয়ে যেতে বললেন। মীরু ভাই ও আলী আকবর ভাইকে নিয়ে আমরাও থানায় যাই। ওসি সাহেব সব কিছু শুনে আমাদের সামনেই এসপিকে ফোন করলেন। পরে এসপি আবার ফোন করলেন এসডিওকে । তখন ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন সচিন্দ্র লাল সিংহ। এসডিও সাহেব মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের সাথে কথা বলে ওসি সাহেবকে বললেন, পূর্ববাংলার এই দুই এমপি ও এমএলএকে পুলিশ প্রটোকশন দিয়ে দ্রুত মূখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর জন্য। তখন মীরু ভাই ও আলী আকবর ভাইকে নিয়ে তারা চলে যায়। এরপর যুদ্ধের প্রশিক্ষনের বিষয়ে খোঁজ খবর নেই।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ বলেন, এপ্রিল মাসের শেষ দিকে কাঠালিয়া ক্যাম্পের দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষনে আমাদের ৪০ থেকে ৪৫ জনকে নেওয়া হয়। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেডিকেল কোরের মেজর আক্তার আর আমাদের প্রশিক্ষনের দায়িত্বে ছিলেন আমাদের কোটবাড়িস্থ চাঙ্গিনী গ্রামের সুবেদার নজির আহমেদ ও সুবেদার ইদ্রিস । এখানে একটানা ১৫দিন প্রশিক্ষন গ্রহন করার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ক্যাম্পটি বাতিল করে দেওয়া হয়। পরে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট, অধ্যক্ষ আবদুর রউফ,সুবেদার নাজির আহমেদ ও সুবেদার ইদ্রিস,সদর দক্ষিনের বাগমারার ভাষা সৈনিক আবু তাহের মজুমদার, বর্তমান কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌদ্দগ্রামের মফিজুর রহমান বাবুল ভাইসহ আমরা রাধানগর চলে যাই। এখানে ৪/৫ দিন থাকার পর আমি আফজল খানকে বলে সোনামুড়া চলে আসি যেখানে রয়েছে আমার অনেক বন্ধু। তখন সারা দেশে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার নারী -পুরুষ শিশু, তরুন ও বৃদ্ধাসহ সকল বয়সের মানুষ আসছে হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে টিকতে না পেরে। আমরা বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম,সীমান্ত ঘেষে আমরা একটি ক্যাম্প করব নিজস্ব উদ্যোগে। আমাদের কাজ হবে বাংলাদেশ থেকে যে সকল তরুন এই সীমান্ত দিয়ে আসবে , তাদের প্রথমে আমরা আমাদের ক্যাম্পে কয়েকদিন রেখে দিব যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মানুষিক প্রস্তুতি নিতে। পরে তাদের প্রশিক্ষনের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষন ক্যাম্পে পাঠাব নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে। এটা হবে আমাদের একটি ক্যাম্পে পাঠানোর অগ্রবর্তী ক্যাম্প। পরে আমরা সীমান্তবর্তী করাইল্লা মুড়ায় একটা ক্যাম্প করি।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রথম যুদ্ধের কথা জানতে চাইলে ফারুক আহমেদ বলেন, জুনের শেষ দিকে হবে। আমাদের কাছে খবর এলো , চৌদ্দগ্রামের আমানগন্ডা দিয়ে হানাদার বাহিনীর যাতায়াত বেড়ে গেছে। তখন সুবেদার নজির আহমেদের নেতৃত্বে ১২/১৩ জনের একটি বাহিনীকে পাঠানো হয় এ্যামবুশ করার জন্য। আমরা সীমান্ত পাড় হয়ে আমানগন্ডা এ্যামবুশ করে আবার সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে ওপারে চলে যাই। এর কিছু দিন পর মিয়াবাজার সংলগ্ন নোয়াবাজারে একটি ব্রিজ ছিল। হানাদার বাহিনী যাতে চৌদ্দগ্রামের দিকে বেশী যেতে না পারে সেজন্য একদিন ভোর রাতে এসে আমরা মাইন দিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেই। এই অপারেশনেও আমাদের কমান্ডার ছিল নজির আহমেদ । আর আমার হাতে ছিল একটি স্টেনগান।
জুলাই মাসের দিকে অধ্যক্ষ আফজল খানকে হাতিমারা ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন তিনি ক্যাম্পে যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যান। বড়মোরা ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রফেসর আশরাফকে আর বক্্রনগর ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রয়াত অধ্যক্ষ আবদুর রউফ স্যারকে। মাছিমা ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমান চৌধুরীকে। এই চারটি ক্যাম্পকে সংশ্লিষ্ট জায়গায় থেকে উঠিয়ে নিয়ে বাগমা পদ্য নগরে স্থানান্তর করা হয়। জুলাই থেকে একেবারে ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যক্ষ আফজল খান আমাকে হাতিমারা ক্যাম্পের রেশমের দায়িত্ব দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়।আর ক্যাম্পের লিয়াজো অফিসার অধ্যাপক খোরশেদ আলম স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন ক্যাম্পে আগত ইপিআর সদস্যদের সংগঠিত করার। খোরশেদ স্যার বললেন, তুমি যেহেতু নিজে ক্যাম্প করে যুবকদের সংগঠিত করতে পেরেছ , তাহলে এবার তুমি ইপিআরদের সংগঠিত কর। আবার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন কমান্ডের সাথে আমি গেরিলা অপারেশনেও যোগ দিতাম।
করাইল্লা মুড়া ক্যাম্পের একটি ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ বলেন,আমরা আমাদের করাইল্লা মুড়া ক্যাম্পের সামনে সবাই বসে থাকতাম। সাথে সোনামুড়া বাজার ছিল। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষেরা এই বাজার ব্যবহার করত। তারা বাজারে যা কিছু বিক্রি করতে নিয়ে আসতো, তাদের কাছ থেকে চেয়ে আমরা কিছু কিছু রেখে দিতাম। যেমন, একজন ব্যক্তি বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসলে তার থেকে আমরা মাছ রাখতাম। এমন করে চাল ডালসহ আমরা সব খাবার সংগ্রহ করেছি। আবার বিভিন্ন বাজার থেকেও আমরা খাবার সংগ্রহ করে মজুদ করেছি। এক পর্যায়ে আমাদের ক্যাম্পে অনেক চাল ডালসহ বিভিন্ন খাবার মজুদ হয়ে গেল। এ সময় কর্নেল আকবর হোসেন (কুমিল্লা সদরের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী) ও সফিউল আহমেদ বাবুলদের (বর্তমান কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার) ক্যাম্পে তীব্র খাবার সংকট দেখা দিল। তারা হঠাৎ করে একদিন অস্ত্রের মুখে জোড় করে আমাদের ক্যাম্পে এসে আমাদের সব খাবার গাড়িতে ভরে নিয়ে গেল তাদের ক্য্যাম্পে। এরপর আমরা রাগে, দু:খে ও ক্ষোভে আমাদের ক্যাম্প বন্ধ করে দেই।
পরিচয় :
ফারুক আহমেদ। পিতা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ পুলিশ কর্মকর্তা মো.ইদ্রিছ মিয়া এবং মা রেনু বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে তিনি জন্ম গ্রহন করেন কুমিল্লা শহরের কাশারীপট্টিতে। কুমিল্লা ইউছুফ হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ছাত্রলীগের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামেই একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশ নিয়েছেন তিনি। তাই হাই স্কুলের ছাত্র হলেও দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাল ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষন শুনার পরই মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন যুদ্ধে যাওয়ার।
বাঙ্গালী জাতি যে দিন বিজয়ের আনন্দে উদ্বেল, সেই দিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হানাদার বাহিনীর হাতে তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস মিয়া শহীদ হন।