খনিজ সম্পদ রক্ষায় বিধিমালা প্রয়োজন

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ মাস আগে

বাংলাদেশের বালু ও মাটিতে মূল্যবান প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের উপস্থিতি অত্যন্ত লক্ষণীয়। জিপিএস সংরঞ্জাম, ব্যাটারি, সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সরঞ্জাম, অস্ত্র, যোগাযোগ সরঞ্জাম, বিভিন্ন ইলেক্সনিক্স গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহার হয়। নদীর বালু ও মাটি থেকে পাওয়া উপাদান কাঁচামাল হিসাবে উড়োজাহাজ, ট্রেনসহ মোটরগাড়ির উইন্ডশিল্ড বিভিন্ন যানবাহনে ব্যবহৃত হয়। বালু থেকে উৎসারিত অন্যান্য খনিজ পৃথক করে ইলেকট্রনিক্স রং, প্লাস্টিক পেইন্ট, সিরামিকসহ নানামুখী শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া উড়োজাহাজের খুচরা যন্ত্রাংশ, গাড়ীর পলিশিং পেপার, মানবদেহের হাঁটুর জয়েন্টবলে, নকল দাঁতসহ লোহার আকরিক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
বালু থেকে পাওয়া মোনাজাইটেথ কালার টেলিভিশনের পিকচার টিউব ক্যাথডরে ও ক্যামেরার লেন্সের কোটিং হিসাবে কাজে লাগানো হয়। এ ধরনের খনিজপদার্থ পরমাণু প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ খনিজের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান, গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ^বাজারে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন হচ্ছে টিটেনিয়াম, যা পাওয়া যায় ইলমেনাইট খনিজ পদার্থ থেকে। এ খনিজ পদার্থটি বাংলাদেশের উপকূল, সৈকত আর ব্রহ্মপুত্রের প্রবেশমুখের বালিতে সর্বোচ্চ পরিমাণে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে উড়োজাহাজ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হিসাবে টিটেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। উন্নতমানের রং তৈরিতে বিশেষ করে রং এর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য টিটেনিয়াম ব্যবহার অপরিহার্য। বিশে^ খনিজ বালু ও মাটির মৌলিক এ উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব মৌলিক উপাদান সর্বোচ্চ উৎপাদানকারী দেশ চীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, ২০২২ এর অক্টোবর ৪৫০ মেট্রিকটন ওজনের ১৭টি কনটেইনার মূল্যবান খনিজ ইলমেনাইট ও টিটেনিয়াম বালু আটকে দিয়েছে চট্টগ্রাম কাষ্টম কতৃপক্ষ। ভূমি মন্ত্রনালয়ের অনুমতি ছাড়া বিধি বহির্ভূতভাবে বালু রপ্তানি হচ্ছিল বলে চালানটি আটকে দেয়া হয়। প্রতি কনটেইনারে প্রায় ৪৫০ মেট্রিক টন বালু ছিল। আটক করা এ বালু রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ২২ হাজার ৫০০ ডলার।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম কাষ্টমস কর্তৃপক্ষের আটককৃত উল্লেখিত বালিতে প্রতি ১ হাজার কেজিতে ৬ কেজি ইলমেনাইট পাওয়া যায়। এ পরিমাণ ইলমেনাইট থেকে দুই কেজি ৪০০ গ্রাম টিটেনিয়াম পাওয়া যায়। প্রতি কেজি টিটেনিয়ামের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ২০ হাজার ৫০০ থেকে ২২ হাজার ডলার। ভূমি মন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ উপকূলীয় এলাকায় খনিজপদার্থ সমৃদ্ধ বালুর ১৭টি পয়েন্ট রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মহেশখালী, শীলখালি, কলাতলী, ইনানী, সাবরাং, টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, কুতুবদিয়া, ফকিরহাট, কুতুবজোম পয়েন্ট অন্যতম। এসব পয়েন্টের বালুতে জিরকন, ইলমেনাইট, গার্নেট, ম্যাগনেটাইট, রিউটাইল, মোনাজাইটেথ, কারনাইট, লিওকনিক্সসহ আটটি খনিজ পদার্থ রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ ও কক্সবাজার সৈকত এলাকার বালিতে কমপক্ষে ২০ লাখ টন খনিজ পদার্থসমৃদ্ধ বালু রয়েছে। এর মধ্যে জিরকন রয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ১১৭ টন, রিউটাইল ৭৪ হাজার ২৭৪ টন, গার্মেট ২ লাখ ২২ হাজার ৭৬১ টন, মেগনেটাইট ৮০ হাজার ৫৯৯ টন, মোনাজাইট ১৭ হাজার ৩৫২ টন, ইলমোনাইট ১০ লাখ টনসহ অন্যান্য খনিজ পদার্থ। এ খনিজ বালু মহামূল্যবান। জিরকন ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক বিকিরণের উপাদান হিসাবে। মরিচা প্রতিরোধেও জিরকন ব্যবহৃত হয়। (বিসিএসআইআর সূত্রে প্রাপ্য)
বালু ও মাটি রপ্তানী করার উদ্যোগ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রনালয়। এ লক্ষ্যে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০২৪ এর খসড়া তৈরি হয়েছে ভূমি মন্ত্রনালয়ে। সংশ্লিষ্টদের মতামতের জন্য এটি মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বালু ও মাটি রপ্তানির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় তাহলে প্রতিবছর হাজার কোটি ডলারের মূল্যবান খনিজ সম্পদ বৈধভাবে চলে যাবে বিদেশিদের হাতে। এখানে উল্লেখ্য যে, চোরাই পথে বালু ও মাটি বিদেশে পাচারের বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়েছে। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনÑ২০১০ এ বালু ও মাটি রপ্তানির আইন আছে। আইন থাকার কারণে বিধিমালা তৈরি একান্ত প্রয়োজন। তবে মূল্যবান খনিজ বালু ও মাটি যাতে কোনভাবে পাচার না হয়, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে বিধিতে।
হিমালয় থেকে আমাদের নদ-নদী উৎসারিত হয়ে শত শত মাইল গড়িয়ে এসে পানি পড়ছে নদীতে। পানির সঙ্গে মূল্যবান খনিজসম্পদ তলানী আকারে এসে যুক্ত হচ্ছে। এসব সম্পদ আমাদের নদী ও সমুদ্রে রয়েছে। ইতিমধ্যে জার্মানি থেকে বিসিএসআইআর’এর বিজ্ঞানীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। তারা বালু থেকে উন্নতমানের কাঁচ তৈরির পদ্ধতি শিখে এসেছেন, যা দেশে কাঁচ শিল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। নদীর তলদেশ ও সমুদ্রসৈকতের বালুতে খনিজ পদার্থের উপস্থিতি বেশি। শক্ত আইন-বিধি করে এসব সম্পদ রক্ষা জরুরী। না হয় এসব মূল্যবান সম্পদ পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আইন ও বিধির ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ যেন পাচার করতে না পারে সেবিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকা জাতীয় দায়িত্ব।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ