ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর মুক্তি নিয়ে জনমনে নানা কৌতূহল দেখা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যে মন্ত্রী-এমপিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র সাবের চৌধুরীই জামিন পেলেন। তাঁকে দ্রুত জামিন ও মুক্তি দেওয়ার ঘটনাটিও বিরল। হত্যা মামলায় রিমান্ডে পাঠানোর পরদিনই ছয় মামলায় জামিন দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে হাজতখানা থেকে সাবেরকে মুক্তি দেওয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার এ ঘটনা ঘটে। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাবেরের জামিন আদেশের পর আদালত কক্ষেই বিক্ষোভ করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাদের কাউকে কাউকে বিচারকের উদ্দেশে গালমন্দ করতেও দেখা গেছে।
সাবেরের ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপি, জ্যেষ্ঠ নেতা, এমনকি আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীও গা-ঢাকা দিয়েছেন। সেখানে সাবের তাঁর রাজধানীর পরীবাগের বাসাতেই ছিলেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সাবের হোসেন চৌধুরী সারাবিশ্বের সংসদ সদস্যদের সংগঠন ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। দেশের রাজনীতিতেও তাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর চমৎকার বোঝাপড়া। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের রয়েছে অব্যাহত সমর্থন। তাঁর মুক্তিতে এই শক্তির প্রভাব থাকতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন সমকালকে বলেন, আইনে বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু একজন হত্যা মামলার আসামি এত দ্রুত ছাড়া পেলে তা খারাপ বার্তা বয়ে আনে। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্ন আসবে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেতাত্মারা এখনও বিচার বিভাগে রয়েছে মন্তব্য করে জয়নুল আবেদীন বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, দুর্নীতিগ্রস্তরা এত দ্রুত জামিন পেয়ে যাবেন। এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি রাখা উচিত। অন্যথায় বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা হারিয়ে যাবে। যেখানে সরকারপ্রধান পালিয়ে গেছেন, শহীদদের রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি, সেখানে কীভাবে এত দ্রুত তিনি জামিন পেলেন?
গতকাল বিকেলে শুনানি করে সাবেরকে ছয় মামলায় সন্ধ্যায় জামিন দেওয়া হয়। এর পরই আদালতের হাজতখানা থেকে মুক্তি পান তিনি। সে সময় সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন করলেও সাবের কোনো উত্তর দেননি। তাঁর আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন পাশ থেকে বলেন, সাবের চৌধুরী অসুস্থ।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কালো রঙের একটি গাড়িতে করে সাবের চৌধুরী আদালত এলাকা ছাড়েন। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের আমলেও সাবের গ্রেপ্তার বা আটক হননি। এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে ‘আঁতাতের’ অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। যদিও তখন তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে দলের ভেতরে-বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। ওই সময় তিনি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব ও দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
পরে নবম সংসদে তিনি নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ে। ফলে দশম ও একাদশ সংসদে তিনি এমপি হলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না। তবে একাদশ সংসদের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকা-৯ আসনে জয়ী হয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী হন।
রাজনীতিতে আসার আগে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত সাবের ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ সব পদ পেয়েছিলেন সাবের। তৎকালীন মতিঝিল-সবুজবাগ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। এই আসনে তখন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বর্ষীয়ান নেতা মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু। সেই নির্বাচনে জয় পেয়ে সাবের হন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী। একই সময়ে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও সভাপতি হন।
সাবেরের ভাই সাঈদ হোসেন চৌধুরী বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া সাবেক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের আরেক সাবেক এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে।