১০৫ মণ সবজির সঙ্গে ১৫ মণ চাল-ডাল দিয়ে ‘সবজি খিচুড়ি ’

খাবেন ৬ হাজার লোক
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ মাস আগে

১০৫ মণ সবজি কেটেকুটে রাখা হয়েছে বিশাল টেবিলজুড়ে। খিচুড়ি রান্নার জন্য সেখান থেকে ডেগে নেওয়া হয় এসব। গতকাল বিকেলে পাবনার বেড়া পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া মহল্লায়ছবি: প্রথম আলো

মহল্লার সবচেয়ে প্রশস্ত ও ফাঁকা জায়গায় বসানো হয়েছে ১০টি অস্থায়ী চুলা। পাশেই খাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে প্যান্ডেল। সেটি আপাতত ফাঁকা। লোকজনের সব ব্যস্ততা যেন ওই চুলাগুলো ঘিরেই। বিকেল চারটা থেকে ১০টি ডেগে রান্না করা হচ্ছে সবজি খিচুড়ি। সেখানে কয়েক দফায় ১০৫ মণ সবজির সঙ্গে ১২ মণ চাল ও তিন মণ ডাল মিলিয়ে চলে রান্নাবান্না। প্রথম দফা শেষে গতকাল শুক্রবার রাত আটটা থেকেই শুরু হয় খাওয়াদাওয়া পর্ব।

পরে আরও দুই দফায় চলেছে রান্নার পর্ব। গতকাল রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত ৬টি মহল্লার অন্তত ছয় হাজার নারী-পুরুষ খাওয়া-দাওয়ার পর্বে শামিল হয়েছিলেন। পাবনার বেড়া উপজেলার ৬টি মহল্লার বাসিন্দারা এই আয়োজনের নাম দিয়েছেন ‘সবজি-খিচুড়ি উৎসব’। গতকাল বেড়া পৌরসভার দক্ষিণপাড়া মহল্লায় এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এলাকাটিসহ দাসপাড়া, কর্মকারপাড়া, শেখপাড়া, শাহপাড়া ও হাতিগাড়ার বাসিন্দাদের সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল উৎসবটি।

মহল্লাগুলোর কয়েকটি বাড়িতে নারী সদস্যেরা মিলে সবজি কাটাকুটি ও ধোয়ার কাজ করছেন
মহল্লাগুলোর কয়েকটি বাড়িতে নারী সদস্যেরা মিলে সবজি কাটাকুটি ও ধোয়ার কাজ করছেনছবি: প্রথম আলো

সরেজমিনে জানা যায়, ‘দক্ষিণপাড়া যুবসমাজ’ এর উদ্যোগে ১১ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে এই ‘খিচুড়ি উৎসব’। এ জন্য সুবিধা মতো বছরের কোনো এক দিনকে বেছে নেওয়া হয়। তবে শীতের সময় তুলনামূলক কম দামে প্রচুর সবজি পাওয়া যায় বলে এ মৌসুমেরই চলে ‘সবজি খিচুড়ি উৎসব’। এবার সবাই মিলে গতকাল শুক্রবার দিনটিকে উৎসবের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ২০১৫ সালে দক্ষিণপাড়া মহল্লার ১০–১২ জন তরুণ-যুবক মিলে ‘খিচুড়ি উৎসবের’ শুরু করেন। ওই বছর মহল্লার শতাধিক বাসিন্দাকে সবজি খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছরই এ আয়োজনের পরিধি বেড়েছে। একসময় শুধু দক্ষিণপাড়া মহল্লার যুবকেরা জড়িত থাকলেও এখন দল-মত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আশপাশের ছয়টি মহল্লার বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এ আয়োজনে যুক্ত হয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুতে ভোরবেলায় স্থানীয় হাট-বাজার থেকে প্রায় ১০৫ মণ বিভিন্ন ধরনের সবজি কেনেন আয়োজকেরা। এগুলোর মধ্যে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, শিম, টমেটো, গাজর, মুলা, বেগুন, শালগম, বরবটিসহ আরও কয়েক রকমের সবজি ছিল। এগুলো কেনার পর দক্ষিণপাড়া, দাসপাড়া ও কর্মকারপাড়া মহল্লার অন্তত ২৫টি বাড়িতে সেগুলো কাটা-বাছা ও ধোয়ার জন্য দেওয়া হয়। সকাল থেকেই মহল্লার বিভিন্ন বয়সী নারীরা দল বেঁধে এসব বাড়িতে জমায়েত হয়ে কোটা-বাছায় অংশ নেন। ৪০০-৫০০ নারী মিলে দুপুরের মধ্যেই ১০৫ মণ সবজি কাটা ও ধোয়ার কাজ শেষ করেন।

খিচুড়ি উৎসবের মধ্য দিয়ে মহল্লাগুলোর মানুষ এক দিকে যেমন আনন্দে মেতে ওঠেন, তেমনি পরিণত হয় প্রাণবন্ত মিলনমেলায়। আয়োজকেরা বলেন, এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হলো সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করা। দক্ষিণ পাড়াসহ আশপাশের কয়েক মহল্লার মানুষ বছর ধরে এ ‘সবজি খিচুড়ি উৎসবের’ জন্য অপেক্ষা করেন। অনেক বাড়িতেই মেয়েদের ‘নাইওর’ আনা হয় বাবার বাড়িতে। এ ছাড়া দূরদূরান্তে বাস করা মহল্লার অনেক বাসিন্দাও এ উৎসবকে সামনে রেখে নিজেদের বাড়িতে ফেরেন।

১০টি হাঁড়িতে ৩ দফায় চলেছে রান্না-বান্না। এতেও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা
১০টি হাঁড়িতে ৩ দফায় চলেছে রান্না-বান্না। এতেও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাছবি: প্রথম আলো

আয়োজকদের কয়েকজন বলেন, উৎসবের জন্য প্রয়োজনীয় সবজি, চাল, ডালসহ অন্যান্য সামগ্রী খুব সহজেই সংগ্রহ করা হয়। দক্ষিণপাড়া, দাসপাড়া ও কর্মকার পাড়াসহ কয়েকটি মহল্লার লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবজি, তেল, চাল, ডাল দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার নগদ অর্থ দিয়েও সহায়তা করেন। ফলে সবজি খিচুড়ির উপকরণের অভাব হয় না।

দক্ষিণপাড়া মহল্লার জুয়েল মোল্লা ঢাকার সাভার এলাকায় একটি টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি করেন। সেখানে কর্মসূত্রে তাঁর ভাই, বোনসহ আরও কয়েকজন আত্মীয়ের বাস। এ উৎসব উপলক্ষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জুয়েল বাড়ি ফিরেছেন জানিয়ে বলেন, ‘খিচুড়ি উৎসবের জন্য আমাদের পরিবারের সবাই সারা বছর অপেক্ষা করি। এই খিচুড়ি উৎসবে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি আমার অনেক বন্ধুও গ্রামে এসেছে। খিচুড়ি খাওয়াটা বড় ব্যাপার না, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দূরদূরান্তে থাকা মানুষদের দেখা পাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার।’

সব প্রস্তুতির পর রাত থেকেই শুরু হয় রান্না। অন্য পাশে প্যান্ডেলে চলে খাওয়ার পর্ব
সব প্রস্তুতির পর রাত থেকেই শুরু হয় রান্না। অন্য পাশে প্যান্ডেলে চলে খাওয়ার পর্বছবি: প্রথম আলো

উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা দক্ষিণপাড়া মহল্লার ফজলুর রহমান বলেন, ‘উৎসবটি কয়েকটি মহল্লার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও মিলনমেলার সৃষ্টি করেছে। গত তিন-চার দিন মহল্লায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মহল্লাসহ আশপাশের কয়েকটি মহল্লায় অন্তত এক হাজার নারী-পুরুষ এই উৎসবকে ঘিরে দূরদূরান্ত থেকে বেড়াতে এসেছেন।’

খিচুড়ি উৎসব এখন এলাকাটির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণপাড়া মহল্লার বাসিন্দা ও মনজুর কাদের মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, দক্ষিণপাড়া মহল্লার তরুণেরা এই উৎসবে মূল ভূমিকা পালন করলেও আশপাশের মহল্লাগুলোর সর্বস্তরের মানুষ এতে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন।