আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অশনি সংকেত – শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

একটি রাষ্ট্র কোন ব্যক্তি,গোষ্ঠী ও নির্দিষ্ট কোন দলের জন্য কোন আইন তৈরী করে না। রাষ্ট্র আইন তৈরী করে একটি দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর জন্য। এই জনগোষ্ঠীর কোন একটি অংশ যদি রাষ্ট্র প্রণীত আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তাহলে সেটা হবে অবশ্যই আইনের শাসনের পরিপন্থী,সামাজিক অপরাধ ,নৈতিকতার গর্হিত অপরাধতো বটেই। কারণ একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমার যেমন অধিকার ভোগ করার আইনানুগ বিধান রয়েছে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের অপরাপর নাগরিকদেরও এ অধিকার ভোগ করার অধিকার আছে। আমাদের সংবিধানের তৃতীয়ভাগে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গে বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশে আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি জনগনের অনিহা বা আস্থা সংকটের কারণেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। কিন্তু নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার মতো অপরাধ আইন দ্বারা তো নিষিদ্ধই বরং বিবেক দ্বারাও অসমর্থিত। গত ১২ই জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে ডাকাতির সন্দেহে দুইজনকে পিটিয়ে নিহত ও একজনকে মারাত্মক আহত করা হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের যা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধও।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, চোর বা ডাকাত ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলে দ-বিধি ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। অপরাধের ধরণ মতে, কারাদ-ের মেয়াদ এবং জরিমানার টাকা বাড়বে।

দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিন এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১১টার দিকে, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ধারোরা ইউনিয়নের পালাসুতা গ্রামে এলাকার মসজিদে মসজিদে ডাকাত আতঙ্কের ঘোষণা দিয়ে সন্দেহভাজন তিনজনকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এতে দুজন নিহত হয়। অপর একজন আহত হয়।

স্থানীয় একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, এর আগে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও ওই রাতে উপজেলার কোথাও ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। এমনকি ডাকাত বলে তাদের চিহ্নিতও করেনি কেউ। শুধু মাত্র সন্দেহ করেই তিনজন লোককে ধরে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় জনতা। এতে দুজন মারা যায়। নিহতের পরিবারবর্গ ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, গণপিটুনীতে নিহতরা চুরি কিংবা ডাকাতির সাথে জড়িত ছিল না ।

অপরাধীর অপরাধ প্রমানিত হলে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে সংবিধানে নির্দিষ্ট আইন রয়েছে, রয়েছে আদালত। যা আমরা উপরে পড়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রায়ই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে তা সমর্থন যোগ্য তো নয়ই এবং এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। ডাকাতি কিংবা চুরি করলে আইনের মাধ্যমে না দিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে মারা হলে সেটা হবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড। আর বিচার বহিভূর্ত হত্যাকান্ড পরিষ‹ার ভাবে বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী কাজ। এ ধরনের ঘটনা রোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনশৃংখলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরী হয়ে পড়ছে।
আমাদের দেশে কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে সবার আগে খতিয়ে দেখতে হবে সেই বিষয়টি। কারণ, চিল কান নিয়ে গেছে বলে কানে হাত না দিয়ে অর্বাচিনের মত চিলের পেছনে দৌঁড়ানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। অর্থাৎ আগে আমাদের একেবারেই গোড়ায় হাত দিতে হবে। আগে খুঁজে বের করতে হবে কেন মুরাদনগরের মানুষ হঠাৎ করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে দুইজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল । আরেকজন এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকলেও তার অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই বলে জানা গেছে। গণপিটুনীর ঘটনা যে শুধু মুরাদনগরেই ঐ দিন ঘটছে তা নয়। এটি আমাদের কুমিল্লা জেলাসহ সারা দেশেই হরহামেশা ঘটছেই। একটি জাতির জন্য এটি মোটেই গৌরবের কাজ হতে পারে না।
মানুষ তখনি আইন নিজের হাতে নেয় যখন সে মনে করে, আইনের কাছে গিয়ে সে সুষ্ঠ বিচার পাবে না বরং সে আরো বেশী হয়রানী হওয়ার সম্ভবনায় থেকে যেতে পারে। পুলিশ ও বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।
অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্য যে, গণপিটুনিতে অংশ নেয়ার মত সামাজিক অপরাধে আজ পর্যন্ত দেশের কারো বিরুদ্ধে সাজা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অথচ এই অপরাধটি প্রতিনিয়তই সংগঠিত হচ্ছে।
অনেকে বলেন, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় অপরাধী সাজা পায় না বলেই গণপিটুনী দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু অপরাধীকে সাজা দিতে গিয়ে নিজে আরেকটি মানুষ মারার মত গুরুতর অপরাধ করবেন , তা হতে পারে না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং আস্থা রাখা আপনার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন না করে বরং আরেকটি অপরাধ করার মতো আইনগত বা নৈতিক ভিত্তি আপনার নেই।

আমাদের দেশে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে। সেটি হলো ‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা পুলিশে ছুঁলে ১৮ ঘা’ । প্রাচীনতম এই প্রবাদটি মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। সাধারণ জনগনের কাছে এই বার্তাটি পরিষ‹ার করতে হবে যে, তিনি যদি পুলিশের কাছে যান কিংবা বিচারের আশায় বিচারালয়ে যান তাহলে তিনি হয়রানী হবেন না, তিনি প্রতিকার পাবেন। এটি প্রমাণ করতে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে পুলিশকেই। থানা পুলিশকেই দায়িত্ব নিয়ে শত ভাগ প্রমাণ করতে হবে যে, তাদের (পুলিশের) জাতীয় স্লোগান অনুযায়ী , পুলিশ জনগনের বন্ধু। বন্ধুর কাছে দু:খ কইতে গিয়া যেন আমাদের নতুন করে আরেক ঝামেলায় না পড়তে হয়। আইন নিজের হাতে নয়, পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বন্ধু পুলিশকেই তাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থা সংকট রয়েছে তা পুরাপুরি জনগনের মন থেকে মুছে দিতে হবে। প্রমাণ করতে হবে পুলিশের হয়রানী নয় বরং পুলিশের কাছে গেলে মানুষ তার ন্যায় বিচার পাবে নিশ্চিত ভাবেই। একই সাথে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে নিজ নিজ থানা এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই ক্ষেত্রে জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই। এজন্য জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সুধী সমাজ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে যৌথ ভাবে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সভা করতে হবে। জনগণকে বুঝাতে হবে আপনারা কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। আপনারা পুলিশের কাছে আসেন। পুলিশ আইনগতভাবে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আপনারা পুলিশ কর্তৃক হয়রানীর শিকার হবেন না।
পরিশেষে জনগণকে অনুরোধ করে বলব, বিচার পদ্ধতির সংস্কার বা সংশোধন কিংবা আইনের পুরোপুরি বা¯তবায়নের প্রত্যাশা করাটাই একজন সুনাগরিক হিসেবে আপনার দায়িত্ব। আসুন, আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বটি পালন করি।
লেখক : সাংবাদিক,সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।মোবাইল :০১৭১১-৩৮৮৩০৮