আওয়ামীলীগ নেতা মেয়র তাপস ও বিএনপি নেতা চাঁদ দুই জনই যখন একই অপরাধে অপরাধী…শাহাজাদা এমরান

সময়ের কথা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

হঠাৎ করে কেন যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠল আমাদের রাজনীতির ময়দান। এতদিন বিরোধী দলের আন্দোলনে সরকারের কিছুটা নমনীয় নীতি থাকলেও গত ১৯ মের পর থেকে পুলিশ দিয়ে মাঠ নিয়ন্ত্রনের একটা লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একই সাথে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও বেশ জোড়ালো বক্তব্য শুরু হয়েছে। দলের স্বয়ং সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, এবার আর শান্তি সমাবেশ নয়, এবার প্রতিরোধ করা হবে। যার প্রমাণ হিসেবে গত ২২ মে দেখা গেল রাজশাহীতে বিএনপি মাঠেই নামতে পারেনি। বিশেষ বাহিনী দিয়ে ঘেরাও ছিল বিএনপি দলীয় কার্যালয়। রাজধানী ঢাকাতেও পুলিশের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। অন্য দিনের তুলনায় এদিন সারা দেশেই পুলিশ ছিল কিছুটা কঠোর।
অপর দিকে, গত ২১ মে রোববার বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটিকর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসের একটি বক্তব্য ভাইরাল হতে হতে শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এমন কি দেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বুধবার আদালতকে জানিয়েছেন , তাপসের বক্তব্য আমরা আগে খতিয়ে দেখি।
আওয়ামীলীগ বনাম বিএনপি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই মধ্যম সারির নেতার বক্তব্যে এখন সারা দেশ তোললপাড়। ইতিমধ্যে দেশের সংবিধান প্রনেতাদের অন্যতম একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, মেয়র তাপসের বক্তব্য আদালত অবমাননা এবং তিনি ‘তার এই বক্তব্যে আনফরচুনেটলিৃ’ মন্তব্য করে ইতিমধ্যে বুধবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের নজরে আনেন।
১. গত ১৯ মে শুক্রবার বিকালে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিবপুর মহাসড়কের পাশে বিএনপির আন্দোলনের সমর্থনে জেলা ও মহানগর বিএনপি আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সাঈদ চাঁদ তার আড়াই মিনিটের বক্তব্যে বলেন, আমরা এখন আর ১০ দফা ২৭ দফার মধ্যে নেই। আমাদের এক দফা শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠানো। তিনি আরো বলেছেন, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার জন্য যা যা করা দরকার, আমরা তাই করব।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা জজ কোর্টের আইনজীবী ও চৌদ্দগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা খোরশেদ আলম বলেন, কাউকে হুমকি দেওয়া দন্ডবিধির ৫০৬ ধারায় শস্তিযোগ্য অপরাধ। রাজশাহীতে বিএনপি নেতা চাঁদ সাহের যে বক্তব্য দিয়েছেন তা হত্যার হুমকি শামিল। কোন সুস্থ ব্যক্তি কোন নাগরিককে এভাবে কবরস্থানে পাঠানোর কথা বলতে পারেন না। এটা একদিকে যেমন রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে অপরদিকে সামাজিক বিশৃংখলাও দেখা দিয়েছে। আমরা বিএনপি নেতা চাঁদের বিচার দাবি করছি।
২. অপর দিকে, গত ২১ মে রোববার রাজধানী ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেছেন, মনটা চায় আবার ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসি। একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম। মশিউজ্জামানকে (বারের গত নির্বাচনের সাবকমিটির প্রধান) আমরা মনে করতাম ওরে বাবা, কী জানি ফেরেশতা আসছে। সবচেয়ে বড় চোর হলো মশিউজ্জামান। যেসব সুশীল আমাদের বুদ্ধি দিতে যাবেন, সেসব সুশীলকে আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেব। তাপসের এই বক্তব্য বিএনপি নেতা চাঁদের বক্তব্যের মতই ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে দেশময়। ইতিমধ্যে ২৪ মে বুধবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে মেয়র তাপসের এই বক্তব্যের বিষয়ে আদালতে নালিশ জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।
আদালত থেকে বের হয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘তাপস যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি আদালত অবমাননা। তার বক্তব্যে সারা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমরা আশা করছি, আপিল বিভাগের আট বিচারপতি বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।’
আদালতে ‘একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম’ মেয়র তাপসের এমন বক্তব্য নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশ আপিল বিভাগে পড়ে শোনান ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। ব্যারিস্টার আমীর বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আদালতকে বলেন, ‘তার এই বক্তব্যে আনফরচুনেটলি।’
এদিকে, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের নালিশের জবাবে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা আগে এটি দেখি।’
আদালত থেকে বের হয়ে সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম একজন সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘এটা বড় রকমের অবক্ষয়। এর জন্য আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছিলাম। আদালত বলেছেন, তারা দেখবেন। আমরা প্রত্যাশা করছি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এটি দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এই বক্তব্যে বিচার বিভাগ শুধু নয়, সারা দেশের মানুষ মনঃক্ষুণœ হয়েছে। সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে থাকে এই বিচারব্যবস্থার জন্য। বিচারকদের কথা শুনলে গ্রামের একজন চাষিও বলতে পারেন ন্যায়বিচার পাব।’
ব্যারিস্টার আমীর আরও বলেন, মেয়র তাপস সুশীল সমাজ সম্পর্কেও কটাক্ষ করে কথা বলেছেন। বারের সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। বিচার বিভাগকে হেয় করেছেন। এই অধিকার তিনি কোথায় পেয়েছেন? এটা অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তার এই বক্তব্য আদালত অবমাননা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার সিনিয়র আইনজীবী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আলী আক্কাছ বলেন, মেয়র তাপস মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আদালত অবমাননার শামিল। অপর দিকে, সুশীল সমাজকে বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে মেয়র তাপস নি:সন্দেহে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। কারণ, নদীর কালো বিষাক্ত পানিতে ফেললে মানুষ বাঁচতে পারে না । এটা তিনি দন্ডবিধির ৫০৬ ধারায় অপরাধ করেছেন। এই অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত জরিমানাসহ জেল হতে পারে। এড. আলী আক্কাছ আরো বলেন, যেই অপরাধে রাজশাহির বিএনপি নেতা চাঁদের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ একটার পর একটা মামলা করতেছে , মিছিলের নামে বিএনপিকে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে একই অপরাধ করেছেন ব্যারিস্টার তাপস। এখন দেখা যাক কি হয়। যদি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে তাহলে বিএনপি নেতা চাঁদের যা হবে আওয়ামীলীগ নেতা মেয়র তাপসেরও তা হবার কথা।
আজকের সময়ের কড়চায় আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, বিএনপি নেতা চাঁদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নন, এটা যদি দেশের একজন সাধারণ নাগরিককেও বলতেন তাহলেও আমি বলতাম তিনি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন এবং দেশের প্রচলিত আইনে তার দৃষ্টান্ত শাস্তি হোক। কারণ তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। একই কথা বলব, মেয়র ব্যারিষ্টার তাপসের প্রতিও। তিনি এক সাথে অনেক গুলি অপরাধ করেছেন, বলেছেন, ‘একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম’। তাহলে বিরোধী দল যে বলছেন, বর্তমান সরকার আদালতেও হস্তক্ষেপ করে, মেয়র তাপসের বক্তব্য এটা তা প্রমাণ করে কি না , সেটা এখন বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ফেললে মৃত্যুর একটা সম্ভাবনাও থাকতে পারে। আইনজীবীদের দৃষ্টিতে এটাও একটা হত্যার হুমকি।
মেয়র ব্যারিস্টার তাপস ও বিএনপি নেতা চাঁদ দুই জনই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। সুতরাং দেশের আপামর জনগন চায় একই অপরাধের শাস্তিটা যেন একই হয়। কোন প্রভাব প্রতিপত্তি কিংবা ক্ষমতার কারণে যেন কেউ একই অপরাধ করে সাধু থাকবে আর অপরজন শাস্তি ভোগ করবে এমনটা যেন না হয়। এতএব সাধু সাবধান।