আগাম সতর্কবার্তা দুর্যোগে সবচেয়ে সহযোগী

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

এখন দুর্যোগে সতর্কবার্তার কাজ বেশি হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী ও অবশ্য কর্তব্য। যে সংকট সেটা হল আন্তর্জাতিক দুর্যোগ এর কারন নির্ধারন এবং এব্যাপারে যে যতটুকু দায়ী তার পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে ততটুকু অংশগ্রহণ থাকে কিনা। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করি, সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে যেতে পারব না। অবশ্যই আমদের বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসামে যদি অতিরিক্ত বৃষ্টি হয় এর একটা প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এটা আঞ্চলিকতার প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে আমাদের দেশে যে পরিমান কার্বন নি:সরন হয়, সে কারনে তার চেয়ে আমরা বেশি ভুগছি। এতে স্বাস্থ্য ঝুকি ও অর্থনীতিতে ধস নামছে। যে অঞ্চলে দুর্যোগের আভাস রয়েছে, সেখানে কত দ্রুত আমরা জনগনের কাছে সতর্কবার্তা পৌছে দিতে পারি, সেটাই আমাদের সফলতার মাপকাঠি। এ যুগে খুব সহজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্যোগের তথ্য পৌছে দিতে পারা যায় যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সতর্ক হয়ে প্রস্তুতি নিতে পারে। বাংলাদেশে যে রিসোর্সগুলো আছে সেগুলো আমরা ঠিকমত বিতরন করতে পারছি না। এজন্য দক্ষ শিক্ষিত ও সৎ জনবল দরকার। যাতে মানুষের কাছে সঠিক বার্তা ও বিভিন্ন দিক নির্দেশনা পৌছে । আমাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। একজন কৃষক যখন মাঠে কাজ করার পর ঘুমাতে আসে তখন তাঁর কাধের গামছা দিয়ে বিছানা পরিস্কার করেন। কারণ পিঁপড়া ও ধূলোবালি যেন না থাকে। প্রত্যেক নাগরিক যখন চিন্তা করবে দেশটা আমাদের সকলের তখন সবাই মিলে দেশটা পরিস্কার রাখতে পারব। যতক্ষন পর্যন্ত এ বোধশক্তি জাগ্রত করতে পারব ততক্ষন পর্যন্ত যতই পরিকল্পনা করি না কেন ঐ পরিকল্পনা বা স্বপ্নের আংশিক বাস্তবায়ন করা যাবে কিন্তু স্থায়ী করা যাবে না।
একটা পর্যায়ে এসে দুর্যোগপ্রবন এলাকায় মানুষের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুর্যোগে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে এনে জনগনের মধ্যে দুর্যোগ ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা, দুর্যোগের মাত্রা অনুযায়ী কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে সে বিসয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নদীতে কতটুকু পানি বাড়লে কার জন্য কি ক্ষতি সে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারনা দিতে হবে। প্রত্যেক মানুষ যাতে নিজ নিজ অবস্থানের আলোকে দুর্যোগের ক্ষতির বিষয়ে বুঝতে পারে সে ধারনা দিতে হবে। শিক্ষা ও এলাকাভেদে মানুষকে এসব বিষয়ে বোঝানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবছর কোনা না কোন দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নীতি পরিকল্পনায় অনেক ঝুঁকিহৃাসের কৌশল বর্নিত আছে কিন্তু বাস্তবায়নের দুর্বলতাগুলো দুরীভূত করা দরকার দুর্যোগ দুই ধরনের একটি প্রাকৃতিক ও আরেকটি মানব সৃষ্ট। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনেকটা প্রভাবিত করে মানব সৃষ্ট দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্নিঝড়, নদীভাঙ্গন, বন্যা, খরা, এগুলো এখন হয়তো নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু মানব সৃষ্ট দুর্যোগ আমরা মোটেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়, চট্টগ্রামের বাস ডিপোতে আগুন লেগেছে, এগুলি মানব সৃষ্ট দুর্যোগ। এসব দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে সাধারন কোন প্রস্তুতি আমাদের নেই।
সাইক্লোন- জলোচ্ছাসের ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান সতর্কতা জারি হয় বন্দরের প্রশাসক ও জাহাজের ক্যাপ্টেন এর উদ্দেশ্যে। বৃটিশ শাসন আমলে তৈরি আইনের ভিত্তিতে বন্দর কেন্দ্রিক সতর্কবানী এখনও প্রচার করা হয়। মানুষ বিপদসীমার অর্থই বুঝে না। শুধুমাত্র সতর্কতার নম্বর দিয়ে বিপদ বিবেচনা করলে হবে না সাথে উদ্ধারকারী দলের প্রস্তুতি সাধারনের দৃষ্টিতে আনতে হবে। আবার অনেক সময় এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বিষয় রয়েছে। অনেক পুরোনে আইনের সতর্কতা কাজে আসছে না। দূরবর্তী সতর্কসংকেত, দূরবর্তী হুসিয়ারি সংকেত, স্থানীয় সতর্কসংকেত ও স্থানীয় হুসিয়ারি সংকেত, বিপদ সংকেত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত, মহাবিপদ সংকেত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নসহ আরও অন্যান্য সংকেত জটিলতায় ভরপুর। সাধারণ মানুষ এগুলো বুঝে না। ৫নং বিপদ সংকেত কিভাবে ৬-৭ কে টপকিয়ে ৮নং মহাবিপদ সংকেত হয়ে যায় তার কোন অংক ভোলার চরকুকড়ীমুকরী ও হাতিয়ার মানুষের বোধগম্য নহে। কিন্তু ঘূর্নিঝড়ের আগে তারে, বেতারে, মাইকে, মুঠোফোনে এসব সংকেত প্রচার করা হয়। কোন খরচ ছাড়াই ১০৯০ নম্বরে ফোন করলে ঝড়বাদলের আগাম খবর মিলে, কিন্তু এই নাম্বারে ফোন করেও সেই আগের বেতার ভাষনের মত “দু-এক জায়গায় কোথাও কোথাও কখনো কখনো বৃষ্টিপাত হতে পারে” মার্কা কথা শুনা যায়।
২৪/১০/২০২২ইং সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দমকা হাওয়া ও অবিরাম ভারী বর্ষনে ভেঙ্গে পড়া গাছের চাপায়, জোয়ারের পানিতে ডুবে এবং নৌ দুঘর্টনায় প্রানহানীর ঘটনাও ঘটে। এর নামকরন করা হযেছে সিত্রাং। সাধারণ মানুষ সিত্রাং কি জানে না বা পুরোপুরি বুঝে না। অথচ সিত্রাং ঘূর্নিঝড়ের তান্ডবে ১৪ জেলায় শিশু ও নারীসহ ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই উপকুলে ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ভোলার চার উপজেলায় পাঁচজন, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে তিনজন, সিরাজগঞ্জে মা ও ছেলে, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে মা ও মেয়ে, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দুই নারী, টাঙ্গাইলে দুজন, পটুয়াখালীতে ট্রলার শ্রমিক, শরিয়তপুরের জাজিরায় গৃহবধু, বরগুনায় শতবর্ষী নারী, নড়াইলের লোহাগড়ায় গৃহপরিচারিকা, গাজীপুরের কাপাশিয়ায় শিশু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগরে পল্লীবিদ্যুতের লাইনম্যান ও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে একটি শিশু মৃত্যবরন করেছে। ঘুর্নিঝড় সিত্রাংয়ে সারা দেশে হাজার হাজার ঘরবাড়ী এবং কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সাধারণ ঘুর্নিঝড় হিসেবেই দেশে আঘাত হেনেছে সিত্রাং। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটিই ছিল ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রের। দেশের উপকুলের কয়েকশ কিলোমিটার দুরে থাকতে “প্রবল ঘূর্নিঝড়” আকারে ছিল। স্থলভাগে উঠতেই শক্তি হারিয়ে তা সাধারন ঘূর্নিঝড়ে পরিণত হয়। এর নেপথ্যে ছিল তুমুল বৃষ্টিপাত। এটাও সাধারন জনগনের বোধগম্য নয় তার সঙ্গে আবার ছিল সতর্কবার্তার হেরফের।
দুর্যোগ প্রশমন এবং এ খবর টেকসই উন্নয়নের জন্য যে কোন বিষয় সরকার প্রধানকে অবহিত করলেই তিনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেষ্টা করেন। দূর্যোগের পর ক্ষয়ক্ষতি পূরন করার চেয়ে দূর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করাই সর্বোত্তম। বাংলাদেশ সরকারের সে বিষয়েই বেশি চেষ্টা করা উচিত। এ বিষয়ে সরকারের ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সম্মিলিত ভূমিকা ইতিবাচক হবে বলেই সকলের ধারনা। কারণ সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া টেকসইভাবে দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দূর্যোগের ক্ষেত্রে ঘূর্নিঝড়, বন্যা, নদী ভাঙ্গন ও বজ্রপাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে নতুন নতুন যে দূর্যোগের উপাদান তৈরি হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে আরও বেশি আলোচনা ও গবেষণা করা প্রয়োজন। কিন্তু সে সবের খুবই অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশাপাশি মানব সৃষ্ট দুর্যোগেও মনোনিবেশ করা উচিত। দুর্যোগ শহর ও গ্রাম সবখানেই আঘাত হানে। শহরের দুর্যোগ হচ্ছে অগ্নিসংযোগ ও ভূমিকম্প। গ্রাম আর শহর উভয় ক্ষেত্রেই দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও বেশি প্রস্তুতি নেয়া দরকার। আরও অনেক ধরনের দুর্যোগ আসছে সেগুলোর বিষয়ে গবেষণার দরকার। তবে আগাম সতর্কবার্তা সাধারন উপযোগী হলে প্রস্তুতি নেয়া হয় সহজ। এতে আমরা দুর্যোগ সহনশীল জাতিতে রুপান্তরিত হব। দুর্যোগ পরিক্রমায় এগিয়ে যাব আরেক ধাপ।