আমাদের সাংবাদিকদের বোধোদয় হবে কবে ?- শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ১২ মাস আগে

প্রকৃত পক্ষে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য কোন সরকারের আমলেই ‘সময়’ভালো থাকে না, থাকার কথাও না। কারণ, সত্যিকার অর্থে যারা পেশাদার সাংবাদিক,সাংবাদিকতা করেই যাদের অন্ন যোগাতে হয় তারা মনের দিক থেকে কোন দল বা গোষ্টিকে সমর্থন করলেও তাদের পেশাদারিত্বের জায়গায় কখনো এর প্রভাব ফেলে না। আর এদের জন্যই ‘গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ এই নামকরনের যথার্থতা পেয়েছে।

অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে গণমাধ্যম কিছুটা হলেও হুমকির মুখে রয়েছে – এই রূঢ় সত্যটি একমাত্র দলকানা বা চাটুকার,পদলেহনকারি ও অপেশাদারীত্ব গণমাধ্যমের কর্মী ছাড়া এক বাক্যে সবাই স্বীকার করবেন।

বর্তমানে ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট নামে যে আইনটি রয়েছে তা শুধু মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য হুমকিই নয়, অবাধ ও নিরপেক্ষ ভাবে সাংবাদিকতা করার বড় প্রতিবন্ধকও বটে।
আমরা যারা পেশাদার সাংবাদিক আমরা আওয়ামীলীগ,বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি বা জামায়াত বুঝি না। আমরা একটাই বুঝি আমরা নির্ভয়ে কোন রকম ভয় ভীতি ছাড়া জাতির সামনে একটি সঠিক সংবাদ তুলে ধরতে চাই। এটা সংশ্লিষ্ট সরকার গুলোকে সাময়িক বিব্রতকর অবস্থায় ফেললেও আলটিমেট কিন্তু তা দেশ এবং জাতির জন্য কল্যাণকর এবং সরকারও কিন্তু সঠিক পথে আগানোর রাস্তা খুঁজে পায়।

আমার প্রায় তিন দশকের গণমাধ্যমের সাথে থেকে এই উপলদ্ধি হয়েছে যে, আমাদের গণমাধ্যম কর্মীরা সব সময়ই নিজস্ব পেশার প্রতি দায়বদ্ধ থাকে না। একজন বিপদে পড়লে অন্যজন মনে করে আমারতো সমস্যা হয়নি। সুতরাং আমি এই ঝামেলাতে জড়িয়ে কি লাভ ? কিন্তু একটা সময়ে যখন ঝামেলা এড়ানো ঐ গণমাধ্যম কর্মী সত্যি সত্যি সমস্যায় পড়ে যায় তখন আবার অতীতে তার ভূমিকার কথা স্মরণ করে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। এভাবেই সাংবাদিকতা পেশার মানুষ গুলো একে অপরের কাছ থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যার পুরো ফায়দা লুটে নেয় যুগ যুগ ধরে ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী সরকার গুলো।

আমরা পেশাদার সাংবাদিকরা কি পারি না নূন্যতম পক্ষে আমাদের কমন একটি ইস্যুতে এক ও অভিন্ন ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে। আমার কোন সংবাদে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষুদ্ধ হন তাহলে আমাদের আইনেই কিন্তু অনেক ব্যবস্থা আছে। কোন রকম আইনের তোয়াক্কা না করে সরকার কর্তৃক নিবর্তনমূলক একটি আইনকে অবলম্বন করে কেন মধ্যরাতে একজন সাংবাদিককে বাসা থেকে তুলে নিতে হবে। সাংবাদিকরাতো আর ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা লোক নয়। সে তো এই সমাজেরই অংশ। তার অন্যায় থাকতে পারে , সংবাদে পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে, তারজন্য তো অনেক গুলো পর্যায় আছে এটা দেখভালো করার জন্য। কিন্তু কোন পর্যায় না গিয়ে মধ্যরাতে একজন হঠাৎ করে সংক্ষুদ্ধ হয়ে মামলা করল আর আপনিও বিশাল সৈন্য সামন্ত, পাইক পেয়াদা নিয়ে রাতের আঁধারে তাকে উঠিয়ে নিয়ে এলেন। এরপর আবার অর্ধদিন স্বীকার করলেন না তাকে যে উঠিয়ে আনলেন।আবারর হঠাৎ করে আদালতে হাজির করলেন।বললেন মামলা হয়েছে,গ্রেফতার দেখালেন। একবার কি ভেবে দেখেছেন, বাসা থেকে তুলে নেওয়ার পর বিভিন্ন থানায় কিংবা বিভাগে খোঁজ নেয়ার পরও যখন বলেন, আমরা কিছু জানি না , তখন ঐ পরিবারের মানুষিক অবস্থা কেমন হয়। আমাদের দেশের সরকার গুলো কখনো সরকারে থাকতে এগুলো ভেবে দেখে না। যখন ভেবে দেখে তখন সোনার মসনদ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং নিজের উপর যখন একই আইন এসে বজ্রপাতের ন্যায় পড়ে তখন হাফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

লেখাটি শেষ করতে চাই, জার্মানির নাৎসিবিরোধী ধর্মযাজক, কবি ও গ্রন্থকার ফ্রিডরিখ গুস্তাভ এমিল মার্টিন নিম্যোলার এর একটি বিখ্যা উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল,আমি কোনো কথা বলিনি,কারণ আমি কমিউনিস্ট নই ।তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেলো,আমি নিরব ছিলাম,কারণ আমি শ্রমিক নই ।তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, আমি তখনও চুপ ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই । আবার আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই । শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বললো না, কারণ কথা বলার মতো তখন
আর কেউ বেঁচে ছিলো না’।

আমাদের পেশাদার সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতারা বিষয়টি যত তারাতারি উপলদ্ধি করবেন আমাদের দেশ তথা জাতির তত্ মঙ্গল হবে বলে আমি বিশ^াস করি।

লেখক : সাংবাদিক,সংগঠক,টক-শো উপস্থাপক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।