আলিশ^র যুদ্ধে অল্পের জন্য আমি প্রানে বেঁচে যাই – প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -২
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
৭ মার্চের পর থেকেই কুমিল্লাসহ সারা দেশেই সভা সমাবেশের মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য জনমত গঠন শুরু হয়। ২৫ মার্চ কালো রাতে ঢাকাসহ সারা দেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নারকীয় তান্ডব শুরু করে । প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী এ খবর পান ২৬ মার্চ সকালে। তখনি তিনি বুঝে গেছেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা একে এক পারি দিচ্ছে সীমান্তে। বিভিন্ন সূত্রে ওপারের সাথে (ভারত) যোগাযোগ করে এপ্রিলের মধ্যভাগে চলে যান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। পাকিস্থান হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিতে নানা অভিনব পদ্ধতি গ্রহন করে চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এলাকার সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা চলে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী ।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অম্পি ক্যান্টনমেন্টের ইকো কোম্পানীতে কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেন তিনি। এই প্রশিক্ষনে ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ গ্রহন করেন। এর মধ্যে ছিলেন আমাদের নন্দন চৌধুরী,নির্মল সাহা,বাবু লাল,বাদল ধর প্রমুখ যোদ্ধা। এখানে প্রশিক্ষন প্রদান করেন ভারতীয় মেজর এস.কে শিং।পরবর্তী পর্যায়ে আমরা ৩৩জন বিশেষ প্রশিক্ষন নেই। এই প্রশিক্ষনে রাইফেল,এসএলআর,এলএমজি,টুইস মর্টার,আর আর,থার্টি সিক এন গ্রেনেড কিভাবে চালাতে হয় এই বিষয়গুলো ছিল আমাদের প্রশিক্ষনের অংশ। ৩০ জুনের মধ্যেই আমাদের প্রশিক্ষন পর্ব শেষ হয়। প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী ২ নং সেক্টরের সাব কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবের অধীনে যুদ্ধ করেন। শুয়াগাজি,মিয়া বাজার,আলিশ^র ও চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ছিল তার যুদ্ধ ক্ষেত্র।
যুদ্ধের অনুপম গল্প :
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, প্রশিক্ষনের পর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে আমি অংশ নেই জুলাই মাসের মধ্য ভাগে। এ সময় সম্ভবত ২নং সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশারফ থেকে নেতৃত্ব চলে আসে মেজর হায়দারের কাছে। একদিন সকালে আমাদের সাব কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে আমরা অস্ত্রসহ মেজর হায়দারের সাথে দেখা করি। মেজর হায়দার ক্যাপ্টেন মাহবুব থেকে আমাদের দলের সংখ্যা,শক্তি,সার্মথ্য সব কিছু জেনে পরদিনই চৌদ্দগ্রামের মিয়া বাজারে একটি অপারেশনের জন্য পাঠান। এই গ্রুপে আমরা ১৪জন ছিলাম। এর মধ্যে সৈয়দ আহমেদ,আবদুল করিম,সিরাজুল ইসলাম,সিদ্দিক হাওলাদার ও নন্দন চৌধুরীসহ আরো অনেকে ছিলেন। সোর্স মারফত জানতে পারলাম,মিয়াবাজারের উত্তর দিকে চান্দুল দিঘির পাড়ের দিক থেকে আসছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি। তারা কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসতেছিল। তারা চান্দুল দিঘির পাড় এসেই আমাাদের এ্যাম্বুশে পড়ে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। এই যুদ্ধটি প্রায় ঘন্টাখানেক স্থায়ী হয়। যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর দুইজন নিহত হয়। আর আমাদের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার রাজা মিয়া শহীদ হয়। অসীম সাহসী ছিল রাজা মিয়া। যুদ্ধের ঠিক আগ মুহুর্তে রাজা মিয়া আমাকে বলে, ভাই আমি যদি যুদ্ধে মারা যাই, তাহলে যেভাবেই হোক আমার লাশটি যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্থানিরা যাওয়ার পর দেখি আমাদের রাজা মিয়া রক্তাত্ব দেহ নিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তার বুকে,পিঠে গুলি লাগে। আমরা দ্রুত তাকে নোয়াবাজার হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদে নিয়ে যাই। সেখানে তার রক্তাত্ব দেহটি মসজিদের বারান্দায় পরিস্কার করে মরদেহটি তার বাড়িতে পৌঁছে দেই। সেদিন রাজা মিয়ার রক্তাত্ব দেহ ছুঁয়ে শপথ করেছিলাম, হয় যুদ্ধ করে মরব,না হয় দেশ স্বাধীন করে বাড়ি ফিরব।
অক্টোবরে আরেকটি সম্মুখযুদ্ধের গল্প শোনাতে গিয়ে প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন,পুর্ব থেকে আমাদের কাছে খবর ছিল , লাকসাম জংশন হয়ে পাকিস্তান আর্মির একটি দল বিপুল পরিমান অস্ত্র,গোলা বারুদ ও খাদ্য সামগ্রি নিয়ে কুমিল্লা আসতেছে। আমরা ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে আলিশ^র রেলস্টেশনে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। ট্রেনটি আলিশ^র রেলস্টেশনে এসে যখনি থামল, সাথে সাথে আমরা নির্দিষ্ট বগিতে এলোপাতারী গুলি করতে শুরু করি। তারাও আমাদের অবাক করে দিয়ে মুহুর্তেই পাল্টা আক্রমন চালায়। ট্রেনের সাধারণ যাত্রীরা দ্বিকবিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করেছে। আমাদের সোর্সের খবর ছিল ট্রেনের এক বগিতে পাকিস্তানি আর্মিরা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বুঝলাম আরো কয়েকটি বগিতে তারা আছে। যেহেতু আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম। তাই তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমরা পিছু হটি।এই যুদ্ধে আমাদের দুই যোদ্ধা শহীদ হয়। পাকিস্তানি আর্মিরাও কয়েকজন মারা যায়। কিন্তু যেহেতু আমরা পিছু হটে চলে আসি , সেহেতু তাদের সংখ্যাটি আমরা জাানি না। তবে এ যুদ্ধে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিছু অস্ত্রও আমরা নিতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই যুদ্ধে অল্পের জন্য আমি প্রানে বেঁচে যাই।

পরিচয় :

প্রমোদ রঞ্জন চক্রবর্তী। পিতা নিবারন চন্দ্র চক্রবর্তী ও মাতা হেম প্রভা চক্রবর্তী।১৯৪১ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের ঘাসীগ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়।১৯৮০ সালে শিবানী রানী চক্রবর্তীর সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি এখন তিন ছেলের গর্বিত জনক। ১৯৭২ সালে এস এস সি পাস করেই যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। পরবর্তী পর্যায়ে বাম রাজনীতিতেই থিতু হন তিনি।