আয়ের সাথে ব্যয় মিলাতে না পারা মানুষ গুলো ভালো নেই -শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

গত ২১ অক্টোবর এপেক্স বাংলাদেশের জেলা ৬ এর সম্মেলনে অংশ নিতে কুষ্টিয়া গিয়েছিলাম। সকালে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক অফিস সংলগ্ন একটি ছোট হোটেলে নাশতা খাই। সাথে ছিলেন ব্রাহ্মণপাড়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি এপেক্সিয়ান সৈয়দ আহমেদ লাভলু ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোকসুদ আলম। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে আস্তে নাশতা করছিলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম আমরা। কারণ, ২০ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টায় মাইক্রোবাস নিয়ে কুমিল্লা থেকে রওয়ানা দেই এপেক্স বাংলাদেশের অতীত জাতীয় সভাপতি এপেক্সিয়ান এড. সৈয়দ নুরুর রহমানের নেতৃত্বে। সাথে ছিলেন, এপেক্সিয়ান এড. খোরশেদ আলম, এপেক্সিয়ান ওয়ালিউল্লাহ রিপন, এপেক্সিয়ান মাহফুজ।

কুষ্টিয়া গিয়ে পৌঁছি ভোর পাঁচটায়। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের সময় বাদ দিলে আমরা প্রায় ত্রিশ মিনিট যাত্রা বিরতি করি রাত সাড়ে তিনটায় রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলায় ডিনার করার জন্য। রাস্তাঘাট খুবই ভালো। তেমন একটা যানজটেও আমাদের নাকাল হতে হয়নি পদ্মা ব্রিজের বদন্যতায়। পদ্মা ব্রিজ হওয়ার আগে এই রোডে যানজট ছিল নিয়মিত ব্যাপার।

নাশতা খাওয়ার এক পর্যায়ে হোটেল বয় খালিদ (১৯) বলল, স্যার দই দেই। আমাদের দই খুব ভালো। তার অনুরোধের কন্ঠটি আমার কাছে অন্যরকম এক বার্তা দিল। বললাম, কি নাম তোমার। সুন্দর এক হাসি দিয়ে বলল, স্যার খালিদ। বিক্রি কেমন তোমাদের দোকানে। স্যার, এখন আর আগের মত বিক্রি নাই। মানুষ এখন কম খায়। কয়েক মাস আগেও প্রতিদিন ৪০/৫০ কেজি ময়দার পরোটা বিক্রি হতো। এখন ২০ কেজি ময়দার পরোটা বিক্রি করতে কষ্ট হয়। বিক্রি কমে যাওয়ায় মালিক আমাদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। মালিককে বলোনি বেতন কমালে খাব কি, বাড়িতে টাকা পাঠাব কিভাবে? উত্তরে খালিদ জানাল, স্যার দোকান না চললে মালিক বেতন দিব কিভাবে। খালিদের সাথে আর কথা বাড়ালাম না। অর্থনৈতিক দৈন্যদসার বার্তাটি গোটা দেশই যে একই রকম তা আর বুঝার বাকি রইল না।
২০ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় কুষ্টিয়ায় পৌঁছার আগে আমরা ডিনার করি রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার আঞ্চলিক মহাসড়কে। ডিনার শেষ করে চা খাওয়ার সময় কথা হয় কয়েকজন টহল পুলিশের সাথে। কথা প্রসঙ্গে উপস্থিত পুলিশের এক কর্মকর্তা যখন জানলেন পেশা হিসেবে আমি সাংবাদিকতা করি তখন যেন মুহুর্তেই আমি উনার (পুলিশের) হয়ে গেলাম। প্রায় ১০ থেকে ১২ মিনিটের আলাপে সিংহভাগ জুড়েই ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ে। আয়ের সাথে ব্যয় মিলাতে কি যে জেরবার অবস্থা তার বলতে কোন দ্বিধা করলেন না তিনি। অনুরোধ করলেন, আপনারা সাংবাদিকরা অন্য নিউজ বাদ দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে আকাশসম দাম তা নিয়ে লেখেন। তার ভাষায় ‘ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ কমাতে কলম ধরেন সাধারণ মানুষের আত্মার দোয়া কেয়মত পর্যন্ত আপনাদের (সাংবাদিকদের) সাথে থাকবে’।

আগ্রহ ভরে জানতে চাইলাম কেন, পুলিশের তো সমস্যা হওয়ার কথা না। আপনারা রেশম পাচ্ছেন, ভালো বেতন নিচ্ছেন, কিছুটা এদিক সেদিক দিয়েও তো আয় হয়। সব কিছু মিলিয়ে সরকারও তো আপনাদের ভালো সুযোগ দিচ্ছে। একথা শুনে চাকুরির স্বার্থে নাম প্রকাশ না করে এই পুলিশ কর্মকর্তা, তার মাসিক আয় ও ব্যয়ের একটা হিসেব দিলেন নিজ থেকেই।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বিনয়ের সাথে বললেন, ভাই, আপনাদের সাংবাদিকদের মধ্যে যেমন ভালো খারাপ আছে ঠিক আমাদের পুলিশের মধ্যেও আছে। অস্বীকার করব না, হয়তো আমাদের পুলিশের মধ্যে একটু বেশি আছে। কিন্তু আমাদের মধ্যেও অফিসার থেকে শুরু করে একজন কনস্টেবল পর্যন্ত এমন অনেক পুলিশ আছেন, যারা অনেক কষ্ট করে চলে কিন্তু ঘুষ দুর্নীতি করে কিংবা মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা উপার্জন করেন না। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলের সংসার তার। সবাই পড়াশুনা করে। বড় মেয়েটা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ে। বড় ছেলেটা কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে। বাকি দুজন হাই স্কুলে পড়ে। বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া দুই সন্তানকে আগস্ট মাসে বলে দিয়েছি, আমার এই বেতনে আর পারছি না। তোমরা এবার টিউশনি করে পড়াশুনা চালিয়ে নাও। মাঝে মাঝে আমিও সার্পোট দিব। কুষ্টিয়া শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে,চার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার টাকা দিয়ে মাসিক খাবারের টাকা আর খুব একটা থাকে না। এজন্য স্ত্রী এখন সকালের নাশতার পর্বটা কাটসাট করে সংসার সামলাচ্ছে, বাদ দিয়েছে বিকেলের নাশতাও। তার মাসিক আয় ও ব্যয়ের তালিকা দেখে আমি থ হয়ে গেলাম। আয় ও ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পারা জেরবার এই মানুষ গুলোই এখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ।

এই পুলিশ কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, অনৈতিক পথে টাকা উপার্জনকারি, বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, এমপি মন্ত্রী ছাড়া দেশের কোন মানুষেরই আয়ের সাথে ব্যয়ের কোন মিল নেই। অনেকেরই নতুন কাপড় কেনা বন্ধ, তিন বেলা খাবারের খাদ্যাবাসে পরিবর্তন এনেছে, সন্তানদের প্রাইভেট পড়ানো বাদ দিয়েছে। বড় ধরনের রোগের চিকিৎসা না করিয়ে ঔষুধ খেয়ে মুহুর্তটা পার করছে। এই চিত্র কি রাজবাড়ি জেলার পাংসা থানার রাতে টহলরত ঐ পুলিশ কর্মকর্তারই। না! এই চিত্র এখন দেশের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের আড়াই ভাগ মানুষর। অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, দ্রব্যমুল্যের চরম উর্ধ্বগতি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিতে দেশের নিম্মবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবার গুলো আজ বিপর্যস্ত,পরিশ্রান্ত ও নাকাল হয়ে আছে। চলতি বছর প্রত্যেকটি পরিবারেরই ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুন কিন্তু আয় বাড়েনি। কোন কোন পরিবারের আবার আয় কমেছে কিংবা আয়ের একমাত্র উৎসটিও বন্ধ হয়ে গেছে ।

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও এর সাথে পরিবহন ভাড়াসহ অন্যান্য প্রত্যাহিক প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের খরচ প্রতি দিনই বাড়ছে। বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোন সবজি নেই। আগে নিম্মবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্ত মানুষের একটু ভালো খাবার ছিল ফার্মের মুরগি। এখন গরিবের এই ভালো খাবারটির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। কুমিল্লা শহরের ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের হোটেল রেস্তোরা গুলোতে চলে হাহাকার। এখন আর আগের মত মানুষ খেতে আসে না। খেতে আসলেও অপেক্ষাকৃত কম দামের তরকারিটা অর্ডার দেয়। দুই প্লেট ভাতের স্থানে এক প্লেট খায়। কুমিল্লা পুলিশ লাইনে অবস্থিত হোটেল ইষ্টিকুটুমের স্বত্তাধিকারী মো. শাহরিয়ার এই প্রতিবেদককে বলেন, ভাই জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির আগে প্রতিদিন যেই পরিমান গরুর মাংস আমার হোটেলে বিক্রি হতো বর্তমানে তা অর্ধেক নেমে এসেছে।

রানীর বাজার হেয়ার স্টাইলে গত সপ্তাহে চুল কাটাতে গিয়ে শুনি চুল কাটা অর্ধেক কমে গেছে। কারণ জানতে চাইলে জহির জানান, গত ২ মাস হলো চুল কাটা, সেইভসহ আমাদের অন্যান্য সার্ভিসে ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছি। আগে শুধু চুল কাটাতে নিতাম ৭০ টাকা এখন নেই ৮০ টাকা। শহরের বড় সেলুন গুলো নেয় ১০০ টাকা বা তার চেয়ে কিছু বেশি। কাস্টমার কমে যাচ্ছে জেনেও কেন বেশি নাও জানতে চাইলে জহির জানান, স্যার, কি করব সব জিনিসের দাম বেশি। কুমিল্লার সেলুন গুলোতে যত কারিগড় আছে শতকরা ৯০জন হচ্ছে কুমিল্লার বাহিরের। তারা শহরে মেসে থাকেন। মালিক মেস ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিন বেলা রুমে আগে যেই টাকা দিয়ে খেতেন এখন তার দেড়গুন বেশি দিতে হচ্ছে। এখন বেতন না বাড়ালে এই কারিগর গুলো চলে যাবে। সুতরাং বাধ্য হয়ে তাদের বেতন বা কাজের উপর কমিশন বাড়িয়ে দিয়েছি। আর এই বাড়ানো টাকা তো কাস্টমার থেকেই নিতে হবে, নতুবা বাড়তি টাকা কিভাবে আসবে। দাম বাড়ার কারণে যারা সপ্তাহে তিনবার সেইভ করত এখন তারা করে দুই বার। আবার যারা দুইবার করত এখন তারা করে একবার।

কুমিল্লা শহরের একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত ভদ্রলোকের স্ত্রী তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। স্বামী-স্ত্রী মোটামোটি ভালো আয় করেন। তাদের তিন সন্তান। বড় মেয়েকে কুমিল্লার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছেন। কিন্তু জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্বির কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার অবস্থাও এখন বড্ড নাজুক বলে জানান তিনি। কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও থেকে তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি গিয়ে তার স্ত্রীর অফিস করতে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। আগে অনেক সরকারি ছুটিতে স্কুলে যেতে হতো না। এখন অধিকাংশ সরকারি ছুটিতে স্কুলে গিয়ে এই দিবস কি ঐ দিবস পালন করতে হয়। ফলে খরচ বেড়ে গেছে আগের চেয়ে বেশি।

ঐ ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, বাসার মালিক বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করেছে দেড় হাজার টাকা। গ্যাসের দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, পানির দামও বেড়েছে, তিন বেলার যে খাবার ঐ খাবারের উপাদান গুলোর ও দাম বেড়েছে। বাড়েনি আমাদের বেতন। এখন আমাদের মত মোটামোটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের চলতেও খুব কষ্ট হয়। অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে বাধ্য না হলে এখন আর যাই না। আগে স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নিয়ে সপ্তাহে একবার ট্রিট দিতাম। এখন তাও বন্ধ করেছি। বর্তমান অবস্থা চললে মেয়েকে বেসরকারি মেডিকেলে পড়া চালানোটা কঠিন হয়ে যাবে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমার ব্যাংকের চাকুরি কিংবা স্ত্রীর স্কুলে চাকুরির তো বেতন বাড়েনি। বেতন না বাড়লেও যে দ্বিগুণ ব্যয় বেড়েছে তা সামাল দিব কিভাবে- এই চিন্তার কথাই জানাল এই কলাম লেখককে। সুতরাং

তার শেষ কথা, আপনি সাংবাদিক, পত্রিকায় লেখেন।
জগতের সকল প্রাণীরা মনে করে তারা খুব সমস্যায় আছে। তাদের সকল সমস্যা সমাধান হবে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে। অথচ এই গণমাধ্যম কর্মীরা যে কত কষ্টে আছে, কত সমস্যা মাথায় নিয়ে নিজের বেদনার কথা গুলো লুকিয়ে রেখে অন্য জনের আনন্দ বেদনার কথা গুলো দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশ করেন এ খবর কয়জনেই আর রাখে।
গত আগস্ট মাস থেকে পত্রিকার খরচ বেড়েছে তিনগুণ আর বিজ্ঞাপন বা পত্রিকার আয় কমেছে তারচেয়েও বহুগুণ বেশি। দেশের অন্য দশটা পেশার মত আমরাও আয় ব্যয় মিলাতে পারছি না। ঘরের কিংবা বাহিরের খরচের খাতা প্রতিনিয়ত কাটছাট করতে হয়। তবুও মেলে না আমাদেরও হিসাব।

সামগ্রিকভাবে আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে দিতে পারবেন একমাত্র আমাদের সরকার বাহাদুর। সদাশয় সরকার বাহাদুরের কর্ণগোচরে কি পৌঁছবে আমাদের এই আর্তি!

লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা। মোবাইল,০১৭১১-৩৮৮৩০৮ ই-মেইল –sahajadaamran@yahoo.com