ইনডেক্স-বেতন নেই, তবুও তিনি অধ্যক্ষ

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

ইনডেক্স নম্বর নেই। এমনকী পান না বেতনও। তারপরও চালাচ্ছেন একটি প্রতিষ্ঠান। রাজশাহীর দারুস সালাম কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এএইচএম শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর তাকে অবৈধ ঘোষণা করার পরও বহাল তবিয়তে থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তিনি। এমনকী ১০টি পদে নিয়োগ দিতে একটি বিজ্ঞপ্তিও ছেড়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুস সালাম কামিল মাদরাসা। ২০০০ সালে মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ মাসুম বিল্লাহ মারা যাওয়ার পর পদটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০০২ সালের ৯ আগস্ট অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, যোগ্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা শিথিলযোগ্য।

অভিযোগ রয়েছে, যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও তাদের নিয়োগ না দিয়ে মাওলানা শহিদুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি বিধানমতে অধ্যক্ষের জন্য কামিল শ্রেণিতে অন্তত ১২ বছরের শিক্ষকতার অথবা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কিন্তু শহিদুল ইসলামের এ মাদরাসায় যোগদানের আগে বাসুদেবপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় মাত্র ৫ বছর ৪ মাসের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল। এরআগে তিনি অন্য কোথাও যোগদান করেননি।

২০০২ সালের ২০ আগস্ট দারুস সালাম কামিল মাদরাসা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন শহিদুল ইসলাম। এরপর একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর বেতনভাতার জন্য তৎকালীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে অবেদন করেন। কিন্তু অধ্যক্ষের যোগ্যতা না থাকায় তারা তার বেতনভাতা প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং সেটি ছাড় করেননি।

২০০৩ সালে কামিলে তাফসির ও ফিকাহ বিভাগ খোলার জন্য মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে আবেদন করেন শহিদুল ইসলাম। পরে একই বছরের ১৩ জানুয়ারি মাদরাসার গভর্নিং বর্ডির রেজুলেশনে মুফাসসির/ প্রভাষক তাফসির পদে নিয়োগ দিতে বলা হয়। এরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাফসির বিভাগের প্রভাষক পদে আবেদন করেন মাওলানা শহিদুল। নিয়োগ বোর্ডে তিনি নিজেই অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন। এরপর তিনি ওই বিভাগের পদে যোগদান করেন। ৯ মার্চ তার নিয়োগ ও যোগদান অনুমোদন করা হয়।

নিয়োগ পাওয়ার পর বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করেন মাওলানা শহিদুল ইসলাম। সেখানে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সই করেন। ২০০৪ সালের নভেম্বরে প্রভাষক তাফসির পদে তার ৪৩০০ টাকা বেতন প্রদান করা হয়। বেতন পাওয়ার পর তিনি নিজেকে অধ্যক্ষ দাবি করেন। এরপর গভর্নিং বডি ভেঙে দেন। সেই কমিটির সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অধিদপ্তরে অভিযোগ পাঠান।

অভিযোগ তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। এরপর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব গোলাম মোস্তুফা সই করা পত্রে তার অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতির কারণে তার ইনডেক্স নম্বর বাতিল করা হয়। বাতিলের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিট খারিজ হওয়ার পর ২০১০ সালের ২ মার্চ তার ইনডেক্স নম্বর কর্তন করা হয়।

ইনডেক্স নম্বর বাতিলের পর ২০১০ সালে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ধুরইল ডি এস কামিল মাদরাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন মাওলানা শহিদুল ইসলাম। পরে ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর তার ইনডেক্স নম্বর ও বেতন-ভাতা হবে না মর্মে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে এক মাসের ছুটি নিয়ে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। পরে আর সেখানে যোগদান করেননি।

মাদরাসা সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে তিনি মামলায় রায় পেয়ে আবারও রাজশাহীর দারুস সালাম কামিল মাদরাসায় যোগদান করেন। তার সবশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত পদটি ছিল কামিল মোফাসসির পদে। রায়েও তার অরিজিনাল পোস্টের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মাওলানা শহিদুল ইসলাম সেটি না করে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং আবারও বেতন-ভাতার জন্য মাদরাসা অধিদপ্তরে আবেদন করেন। কিন্তু তার বেতন-ভাতা প্রদান করেনি অধিদপ্তর। এমনকী তার ইনডেক্স নম্বর ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি ইনডেক্স নম্বর ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সবশেষ এ ইনডেক্স নম্বর দিয়েই মাদরাসাটিতে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছেন মাওলানা শহিদুল ইসলাম।

চাকরি হারানোর ভয়ে মাদরাসাটির কোনো শিক্ষক মাওলানা শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে নাম প্রকাশে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এমনকী কোনো শিক্ষক মাদরাসা প্রাঙ্গণেও কথা বলেননি। মাদরাসা থেকে দূরে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদরাসার একজন শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসক রাজশাহী, মহাপরিচালক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, পরিচালক পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন তদন্তে তার জালিয়াতি প্রমাণিত। তিনি জোর করে অধ্যক্ষ হিসেবে এখানে আছেন। এ নিয়ে কেউ কথা বললেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

ওই শিক্ষক আরও বলেন, শহিদুল ইসলাম সম্প্রতি ১০টি পদে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। মূলত রাজশাহীর কিছু উচ্চমহলের লোকের হস্তক্ষেপেই তিনি জোর করে চেয়ারে বসে আছেন।

এসব বিষয়ে জানতে মাওলানা এএইচএম শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইলে কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে মোবাইলে কোনো কথা বলবো না। আপনার যদি প্রয়োজন থাকে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এরপর অফিসে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এ প্রতিবেদক। তবে সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল কল দিলেও রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেকগুলো মাদরাসা আছে। এখানে নির্দিষ্ট কোনো মাদরাসার বিষয়ে বলতে পারবো না। তবে তার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।