একটি ফ্ল্যাটের বেদনাদায়ক গল্প

মরিয়ম চম্পা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে শাফানা আফিফা শ্যামী তৃতীয়। মা ফাহিমা নূর ছোট মেয়ে শ্যামীকে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে প্রায় ৫ কাঠা জমির উপর নির্মিত ভবনের একটি ফ্ল্যাট স্থায়ীভাবে লিখে দেন। এরপর থেকেই মূলত শ্যামীর সঙ্গে তার পরিবারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বোনকে ফ্ল্যাট লিখে দেয়ায় বিসিএস কর্মকর্তা ভাইসহ অন্য ভাইয়েরা তার সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বন্ধ করে দেন যোগাযোগ। মা ফাহিমা নূর বিসিএস কর্মকর্তা ছেলেদের সঙ্গে বনানীর বাসায় থাকেন। এক ভাই কানাডায়। আরেক ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকেন। গত রোববার ভোরে ভবনের দোতলার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে সেই নারী আর তার ১০ বছর বয়সী যমজ মেয়েকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার তাদের পাঠানো হয় শেরেবাংলা নগরে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে।
বর্তমানে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন শ্যামী।  শ্যামীর পারিবারিক সূত্র জানায়, শ্যামী উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ২০১২ সালে একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। সাংসারিক অশান্তির কারণে অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তাদের বিচ্ছেদ হয়। মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রয়াত বাবা আবু নঈম মো. আব্দুল আলিম।

বাবার বাসায় থাকা অবস্থায় যমজ দুই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। বর্তমানে তাদের বয়স প্রায় ১০ বছর। এরপর থেকেই শ্যামী বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ২০১৮ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে পারিবারিক ঝামেলা শুরু হয়। বাবার মৃত্যুর পরে শ্যামীর নামে একটি ফ্ল্যাট লিখে দেয় মা। ফ্ল্যাট লিখে দেয়ার পর থেকেই ভাইদের সঙ্গে তার দূরত্ব শুরু হয়। আগে তার খোঁজখবর নিলেও সম্প্রতি তারা উত্তরার বাসা ছেড়ে এবং বিক্রি করে অন্যত্র চলে আসেন। শ্যামীর সম্বল বলতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ফ্ল্যাটটি। তার আয়ের নিয়মিত উৎস বলতে ছিল গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে পাওয়া চার হাজার টাকা। এর বাইরে তার কোনো আয়ের উৎস নেই। দুই মেয়ের পড়ালেখা ও সংসার খরচ মিলিয়ে অনেকটা অকুল পাথারে পড়ে যান শ্যামী। অর্থাভাবে বাসার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ প্রায় সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় কর্তৃপক্ষ। দুই মেয়েকে প্রথমে রাজধানীর নামকরা একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করলেও অর্থাভাবে দীর্ঘদিন ধরে তাদের পড়ালেখা বন্ধ। এসব বিষয় নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন শ্যামী।

তিনি কিছুদিন ভালো থাকেন, কখনো আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাইয়েরা শুরুর দিকে খোঁজখবর নিলেও একপর্যায়ে তারা পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর অভিমান থেকে শ্যামী আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন নি।  বর্তমানে শেরেবাংলা নগরে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে শ্যামীর দুই মেয়ে চিকিৎসাধীন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি শ্যামী। এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক মো. রফিক মানবজমিনকে বলেন, শিশু দুটি অন্য হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তাদের মা শ্যামী আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। তার মানসিক সমস্যা ছিল বলে জানিয়েছে স্বজনরা। তিনি দীর্ঘ ১৫ দিন ধরে একটি কক্ষে আবদ্ধ ছিলেন। এ সময় কক্ষে শুধুমাত্র পানি ছিল। কোনো খাবার ছিল না। শরীরে পানির অভাব হলে ৭ দিনের বেশি মানুষ বাঁচতে পারে না। যেহেতু তারা পানি খেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে একজন রোগী সর্বোচ্চ ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন।

শ্যামীর লিভারসহ কিছু অঙ্গে সমস্যা ধরা পড়েছে। যদিও তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ এবং সচেতন। তিনি নিয়মিত খাবার খাচ্ছেন। পাশাপাশি তার শরীরের লবণের খাটতি সেটা পূরণ করার চেষ্টা করছি। শ্যামীর সঙ্গে কথা বলার সময় তার নাম জানতে চাওয়া হয়। এ সময় তিনি নাম বলেছেন। তবে খুব বেশি কথা বলতে চাচ্ছেন না।  আইনশৃঙ্খল বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শ্যামীর বাবার দুই স্ত্রীর সংসার মিলিয়ে ছয় সন্তান। এর মধ্যে শ্যামীরা চার ভাই ও এক বোন। ভাইবোনদের মধ্যে শ্যামী তৃতীয়। তার চার ভাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এক ভাই কানাডা প্রবাসী। এক ভাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। শ্যামীর বিসিএস কর্মকর্তা ভাই তার মুঠোফোন বন্ধ করে রেখেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেননি তার। শ্যামীর চাচাতো বোন জহুরা রতন রূপা ও তার স্বামী হাসপাতালে এসে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। এর আগে রূপা উত্তরায় শ্যামীর বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ পান। উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে তারা না খেয়ে থাকলেও কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। টাকা না থাকায় ১৫ দিন বাসায় বাজার ছিল না।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন ছিল বিচ্ছিন্ন। বাসার রান্নাঘরে হলুদ-মরিচ, চাল-ডাল কোনো কিছুই ছিল না, ছিল শুধু লবণ। তাদের ঘরে খাবার, পোশাক কিছুই ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে অচেতন হলেও দীর্ঘ ৭ দিন ধরে শুধুমাত্র পানি খাওয়ায় তারা বেঁচে গেছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।   এ বিষয়ে পুলিশের উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুজাহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, শুরু থেকেই আমি দুই শিশু ও তার মায়ের খোঁজখবর রাখছি। উত্তরার বাসায় শিশুদের কোনো পোশাক পাওয়া যায়নি। তাদের মায়েরও তেমন কোনো পোশাক বাসায় ছিল না। ঘরে একটি খাটে জাজিমের উপর খালি একটা ওয়ালক্লথ বিছানো। সবকিছু খুবই নোংরা, দুর্গন্ধময়। বর্তমানে যমজ দুই শিশু এবং তাদের মা অনেকটাই ভালো আছে। শিশুরা আমাকে দেখলে চিপস চকলেট খেতে চায়। ওদের দিকে তাকালে চোখে পানি চলে আসে। তিনি বলেন, বাচ্চাদেরকে শীতের পোশাকসহ তাদের মায়ের জন্যও জামাকাপড় কিনে দিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অনেকেই ওদের খোঁজখবর রাখছেন।

প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করলেও তাদের আপনজনেরা এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ নেয়নি।  এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আয়েশা মাহমুদা বলেন, শ্যামীর পারিবারিক সম্পর্ক যেহেতু শিথিল। একজন নারী এবং শিশুকে দেখাশোনা, ব্যয়ভারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো অভিভাবক না থাকার ফলে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা থেকে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধনের অভাব এর জন্য অন্যতম দায়ী। আমাদের পরিবারগুলো এখন ভেঙে একক পরিবার হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এসব পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে সন্তানদেরকে শিশু বয়স থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ও সম্মানবোধ শেখাতে হবে। সূত্র : মানবজমিন।