কুমিল্লার সর্বত্র হিজড়া আতঙ্ক

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার বিশ্বরোড। বলা হয় মুচি থেকে মন্ত্রী সবাই এই বিশ্বরোডে একবার না একবার আসছেনই। তবে বিশ্বরোড এসে হিজড়ার কবলে পড়েননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কখনও ১০ টাকা কখনও হাজার টাকা। শরীরের পোশাক দেখে চাঁদার রেট নির্ধারণ করে হানা দেয় এই জনগোষ্ঠী। টাকা থেকে হাতের ব্যাগ অথবা অন্যকিছু। সুযোগ পেলে কোন কিছুই ছাড় দেয়না তারা। আর টাকা না পেলে শরীরের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দিয়ে একরকম বাধ্য করে টাকা নেয়া হয়। এমন চিত্র শুধু কুমিল্লার বিশ্বরোড এলাকার নয়। জেলার প্রত্যেক উপজেলার বড় বাজার, সড়ক মহাসড়কের পরিবহনেও এমন চিত্র নিয়মিত। এই ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার অপেক্ষায় থাকে তারা। আর এই জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিতভাবে কাজ করেও ব্যর্থ সমাজসেবা অধিদফতর।

কুমিল্লার প্রবেশপথ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড, জাঙ্গালিয়া বাস স্টেশন, শাসনগাছা বাস স্টেশন, লাকসামের লাকসাম বাজার, মুদাফরগঞ্জ বাজার, বরুড়া বাজার, চৌদ্দগ্রামের মিয়া বাজার, বাতিসা, চৌদ্দগ্রাম বাজার, বুড়িচংয়ের কাবিলা বাজার, নিমসার বাজারসহ উপজেলা ও জেলার গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও স্থানীয় ২০টির বেশি সূত্রে খবর নিয়ে জানা গেছে চাঁদা আদায়ের ভয়াবহ তথ্য।

ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা থেকে চৌদ্দগ্রামগামী বাস যমুনা সার্ভিসের যাত্রী এমদাদুল ইক বলেন, যমুনা বাসটি পদুয়া বাজার বিশ^রোডের পুরাতন সদর দক্ষিণ থানার সামনে থামতেই উঠে পড়ে একদল হিজড়া।চাঁদাবাজি করে নামে পদুয়াবাজারের কান্দিরপাড়গামী সিএনজি স্টেশনে। টাকা দিতেই হয়। অনেক সময় খুচরো থাকে না। তখন যা দেই তা আর ফেরত দেয়না। আর নাই বললেতো মান সম্মান সব শেষ করে দেয়। পুরো শরীরের ওপর চলে আসে।

চাঁদপুরগামী বোগদাদ সার্ভিসের যাত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, গাড়িতে উঠেই হাতে তালি দিয়ে বলবে টাকা দে। মহিলাদের বিভিন্ন বিশ্রী নামে ডাক দিয়ে বলবে, ‘টেকা দে’। নাই বললে হাতে তালি দিয়ে গায়ে ওড়না ফেলবে। তারপর শরীরে হাত দিয়ে টাকা আদায় করে। খুবই বাজে অবস্থা। এদের জন্য নারীরা বেশি ভোগান্তিতে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাস চালক বলেন, আমি কিছু বলছি শুনলে আমারে তারা মাইরা ফেলবে। বাস যদি জায়গা মত না দাঁড়ায় তাহলে শার্টের কলার চেপে ধরে বাস থেকে নামিয়ে মারধর করে। প্রথমে দুই তিনজন থাকলেও এক ফোনে ৩০ থেকে ৪০ জন এসে মারামারি শুরু করে।

যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বুঝেন কিনা? এমন প্রশ্নে এই চালক বলেন, বুঝে আমি কি করবো? আমার জীবন বাঁচাইতে হবে আগে।

কুমিল্লা জজ কোর্টের আইনজীবী ফাহমিদা জেবীন বলেন, ২৭ জানুয়ারি কুমিল্লার এক হোটেলে গিয়ে দেখলাম ভয়াবহ অবস্থা। তারা জামাকাপড় খুলে হোটেলের সামনে বসে আছে। পরে শুনলাম হোটেলে একটি বিয়ের আয়োজন আছে। সেখানে টাকা না দেয়ায় তারা এভাবে বসে আছে। পুলিশ আসলে তারা পুলিশের সঙ্গেও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ২৮ জানুয়ারি আমার ছেলের বিয়ে ছিল। বিয়ের পরদিন ২৯ জানুয়ারি তারা আমাদের বাড়িতে হানা দেয়। প্রথমে ২০ হাজার টাকা দাবী করে। পরে আমার নাম বলাতে মিষ্টির জন্য টাকা নিয়ে চলে গেছে। তারা সবাই আমাকে চেনে ও জানে। তাই কম টাকায় রাজি হয়েছে। নাহলে এক টাকাও কম নিতো না।

চাঁদা আদায়ের স্থান :
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, বিয়ে, শিশুর জন্ম, নাম রাখা অনুষ্ঠান, সুন্নতে খাতনাসহ সামাজিক যেকোন অনুষ্ঠানে এসে হানা দেয় হিজড়ার দল। এসময় ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবী করে তারা। যদি আয়োজনকারীরা টাকা দিতে রাজী না হন। তাহলে আয়োজন পন্ড করে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনা তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিজড়াদের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এই অনুষ্ঠান বা ‘খেপ বা ‘পার্টির সন্ধ্যান দেয় স্থানীয় একটি চক্র। এই চক্রটি এর জন্য হিজড়াদের কাছ থেকেও চাঁদার একটি ভাগ নেয়। এছাড়াও বাসার জানালা বা ছাদে বাচ্চাদের কাঁথা শুকাতে দেখে, বাবুর্চিদের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে, কাজীদের মাধ্যমে বিয়ের খবর পেয়ে, বাড়িতে লাইটিং কিংবা ডেকোরেশন থেকেও তারা খবর নিয়ে থাকে।

আরও জানা গেছে, চাঁদাবাজি করার জন্য প্রত্যেক বাজার বা এলাকাভিত্তিক মৌখিক কমিটি আছে এই জনগোষ্ঠীর। কেউ কমিটির বাইরে গিয়ে কোন কাজ করলে তাকে হিজড়া কমিটি বা দল থেকে বের করে দেয়া হয়। তার ভরণপোষণ কিংবা চাঁদাবাজির সকল রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়।

হিজড়ারা কেন চাঁদাবাজিতে :
হিজড়াদের কাছ থেকে স্বাভাবিক আচরণ প্রত্যাশা করা যায় না উল্লেখ করে জাতীয় মহিলা সংস্থা কুমিল্লা জেলার চেয়ারম্যান মিসেস পাপড়ী বসু বলেছেন, তাদের সমাজ চুত্য হওয়ার নেপথ্যে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ দায়ী হলেও পরিবার সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী। তৃতীয় লিঙ্গের হওয়াতে মূলত পরিবার ও সমাজ থেকে নিগৃহীত হয় এই জনগোষ্ঠী। তাই হতাশা, হিনমন্নতা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে তারা দলভুক্ত হয়। এতে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাই স্বাভাবিক মানুষের মতো সকল কাজ করতে সক্ষম হওয়ার পরেও তারা কোন কাজ না করে উশৃংখল আচরণ করে এবং জোর জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করে। ইদানিং তাদের আচরণে উগ্রতা বেশি লক্ষ্য করছি। তবে তা আমরা সমাধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

চাঁদাবাজির শাস্তি কি :
হোক সে হিজড়া বা অন্য কেউ। এভাবে টাকা নেয়া অবশ্যই চাঁদাবাজি উল্লেখ করে কুমিল্লা জজ কোর্টের আইনজীবী ফাহমিদা জেবীন বলেন, তাদের কর্মকাণ্ড অবশ্যই অপরাধ। যদি কেউ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন অবশ্যই আদালত তার শাস্তি দেবে। চাঁদাবাজির সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। তাদের এমন কাজের জন্য আইনী ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।

হিজড়াদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে উদ্যোগ :
জাতীয় মহিলা সংস্থা কুমিল্লা জেলার চেয়ারম্যান মিসেস পাপড়ী বসু বলেন, হিজড়ারা সমাজ থেকে বঞ্চিত হলেও যারা সমাজের দায়িত্ববান মানুষ তারা কখনও তাদের এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাদের অধিকার, তাদের পাওনা, তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আর কে দাঁড়াবে? আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নাহয় আগামী প্রজন্ম একটি অসুস্থ সমাজে বেড়ে উঠবে।

এসময় তিনি যুক্ত করেন, একটি চক্র এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে অপকর্মে লেলিয়ে দিচ্ছিল। কুমিল্লার সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার সাহেব তাদের নিয়ে ভিন্ন একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তাদের জন্য ‘হিজড়া পল্লী’ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এবং তাদের কর্মক্ষম করে তুলতে সমাজসেবা অধিদফতরের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কর্মে দক্ষ করে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ, বিভিন্ন সময় আর্থিক অনুদানসহ নানান উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু তারা কিছুদিন ঠিক থাকার পর আবার উশৃংখল হয়ে উঠে।

সমাজসেবা অধিদফতর কুমিল্লা জেলার উপপরিচালক জেড. এম. মিজানুর রহমান খান বলেন, আমরা আগেও বহুবার চেষ্টা করেছি। স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তাদের জন্য সেমিনার করেছি। মোটিভেশনাল কর্মশালা করেছি। তাদের স্বাভাবিক আচরণের জন্য তাদের আয়ের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছি। অবেহেলিত এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে, উশৃংখল আচরণ, মানুষকে হয়রানি করে চাঁদাবাজি থেকে ফেরাতে এই সরকার যা যা করা দরকার সবই করেছে। কিন্তু দিন শেষে তারা সবই ভুলে যায়। আর আবারও চাঁদাবাজি শুরু করে। ইদানীং এই মাত্রা আরও বেড়েছে।

তিনি যুক্ত করেন, আমরা তাদের জন্য সেলাই মেশিন ব্যবস্থা করেছি। তাদের মাঝে বিতরণও করেছি। তারা সেলাইমেশিন বিক্রি করে ফেলেছে। আমরা আবারও দেখছি কি করা যায়। কুমিল্লায় অফিসিয়ালি তিন শতাধিক হিজড়া আছে। এরবাইরেও কিছু আছে। তবে ওই সংখ্যাটা বেশি নয়। আমরা চেষ্টা করছি তাদের তাদের চাঁদাবাজির পথ থেকে ফেরাতে।

হিজড়া কারা?
কুমিল্লার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী বলেন, মেডিক্যাল সায়েন্স কখনও একজন মানুষকে হিজড়া বলতে পারেন না । তাদের বলা হয় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ । তারাও একজন স্বাভাবিক মানুষ। প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ যৌন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেয় । যারা ক্রোমোজমের ত্রুটি ও জটিলতার কারণে জন্মগতভাবে যৌন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে জন্ম নিয়েছে তাদের তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয় ।

এসময় তিনি বলেন, একজন স্বাভাবিক মানুষ থেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শুধু লিঙ্গ বিকৃত হওয়াতে তাকে তৃতীয় লিঙ্গের বলে। তাই তারা ডাক্তারও হতে পারে। শিক্ষকও হতে পারেন। এতে কোন সমস্যা নেই। মূলত হিজড়া নামক সংস্কৃতি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। তাই মনে করা হয় তৃতীয় লিঙ্গের কেউ জন্মালেই ওই কমিউনিটিতে পাঠাতে হবে। উশৃংখল হবে। চাঁদা আদায় করে জীবন কাটাবে। তাই হিজড়া সংস্কৃতি বদলাচ্ছে না।

আমরা বিভিন্ন সময় সেমিনার করে তাদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য ট্রিট করি। কিন্তু কিছুদিন পর আবার তারা পরিবর্তন হয়ে যায়। বিভিন্ন এনজিও তাদের নিয়ে কাজ করছে। এগুলো অব্যাহত থাকলে সমাজ এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।