কুমিল্লায় অস্তিত্ব সংকটে হাতে ভাজা মুড়ি

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

খুব বেশি ব্যস্ত সময় পার করছেন কুমিল্লার হাতে ভাজা মুড়ি প্রস্তুতকারীরা। রমজান শুরুর আগেই তাদের এই ব্যস্ততা শুরু হয়। দেখতে সুন্দর ও খেতে স্বাধ লাগলেও দাম কিছুটা বেশির কারণে সাধারণ মুড়ির সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছে না হাতে ভাজা এই মুড়ি। তাই তআধুনিকতার জাঁতাকলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে কুমিল্লার হাতে ভাজা সুস্বাধু মুড়ি।

কুমিল্লার মুড়ির গ্রাম ‘ হিসেবে পরিচিত জেলার বরুড়ার উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রাম। রমজান মাস এলেই এই গ্রামের মানুষের ব্যস্ততা যেন বেড়ে যায়। জানা যায়, প্রায় শত বছর ধরে এই কাজ করে যাচ্ছেন এই গ্রামের মানুষেরা। রমজানকে ঘিরে তাদের বাড়তি চিন্তা। সকাল থেকে শুরু করে দিনভর কাঠের চুলা জ্বালিয়ে মুড়ি ভাজছেন নারীরা। সাথে হাত লাগিয়েছেন পুরুষেরাও। কেউ মুড়ি চালুন দিয়ে পরিস্কার করছেন। কেউবা মুড়ি বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করছেন।

কিন্তু, এই গ্রামের মানুষজনের মধ্যে একটা চাপা আক্ষেপ থেকেই যায়। একসময় এই হাতে ভাজা মুড়ির প্রচলনই ছিলো। ছিলো না কোনো আধুনিকতা। কিন্তু, মেশিনে ভাজা মুড়ির প্রচলন হওয়ার পর থেকেই দিনে দিনে চাহিদা কমছে হাতে ভাজা মুড়ির।

পারিবারিক পেশা হিসেবে ছেলেবেলা থেকেই মুড়ি তৈরি করছেন লক্ষ্মীপুর গ্রামের স্বপন সাহা (৪২)। মুড়ি বিক্রি করে যা আয়ূ হয় সেই টাকায় কোনোমতে সংসার চলছে তার। কিন্তু, অতীতের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে মুড়ি বিক্রি করেই আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলতো। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটজাত মুড়ি আসার পর থেকেই আমাদের হাতে ভাজা মুড়ি কেউ খেতে চায় না।

লক্ষ্মীপুর গ্রামের শ্রীমতি সাহা বলেন, রমজান মাস আসলেই আমাগো ব্যস্ততা বেড়ে যায়। মানুষ এই সময় শখ করে হাতে ভাজা মুড়ি কিনে খায় ইফতারিতে। কিন্তু, বছরের অন্যসময়তো কেউ হাতে ভাজা মুড়ি খায় না। তাই আমাগোও কামকাজ এত বেশী থাকে না। কারণ, মেশিনের তৈরী মুড়ি খেতেও যেমন স্বাধ না আবার দামও কম। মানুষ এখন স্বাধের দিকে না তাকিয়ে কম দামের মুড়িটা কিনতে চায়।

গক ২ দিন কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক কেজি মেশিনে ভাজা মুড়ি ৭০/৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু, সেই তুলনায় হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি হয় ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকায়।

মেশিনে ভাজা মুড়ির গুণগত মান ও স্বাদ হাতে ভাজা মুড়ির তুলনায় অনেকাংশেই কম। কিন্তু, মেশিনে ভাজা মুড়ির দাম কম হওয়ায় ক্রেতারা এর দিকেই ঝুঁকছে বেশী।

রাজগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী হারুন মিয়া বলেন, রোজার মাস আসলেই আমি দোকানে হাতে ভাজা মুড়ি উঠাই। কারণ এই সময়ে এইটা মোটামুটি বিক্রি হয়। কিন্তু, অন্যসময় সবাই প্যাকেটের মুড়িই খায়।

আরেক ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন বলেন, হাতে ভাজা মুড়ির তুলনায় প্যাকেটের মুড়িই বেশী বেচা কেনা হয়। মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তরাই প্যাকেটের মুড়ি খায়। প্যাকেটের মুড়ির দাম হাতেভাজা মুড়ির তুলনায় কম হওয়ায় এটাই বেশী চলে।

হাতেভাজা মুড়ির দাম বেশী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর গ্রামের দূর্গাচরণ পাল জানান, মুড়ি তৈরী হয় মূলত দুই ধরনের চাল থেকে। এর একটি গিগজ চাল। এ চালের মুড়ি লম্বা হয়। তবে বৈশাখ মাসে শুরু হবে টাফি চালের মুড়ি ভাজা। এ চালের মুড়ি গোল হয় এবং বেশ সুস্বাদু। এই দুই ধরণের চালের দাম আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে। । আবার কাঠ, বালি, মাটির হাঁড়ির সবকিছুর দাম এখন বাড়তি, তাই মুড়ির দামও বেশী। মিলের মুড়িতে তো ক্যামিকেল মিশায় আবার তারা বানায় অন্য কমদামী চাল দিয়ে। তাই ওগুলার দাম কম।

অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি পাশাপাশি আধুনিকতার জাঁতাকলে পড়ে এভাবেই দিনে দিনে বিলীন হওয়ার পথে হাতে ভাজা মুড়ি। মেশিনে ভাজা মুড়ির সাথে পাল্লা দিতে দাম একটু কমিয়ে রাখতে হয় তাদের। এতে করে লাভ কম হওয়ায় কেউ কেউ ঝুঁকছে এখন অন্য পেশায়। সরকারের যথাযথ উদ্যোগ ই পারে এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা মুড়ি কে টিকিয়ে রাখতে।