কুমিল্লা ইপিজেডের তরল বর্জ্যরে কারণে ক্ষতির পরিমাণ ৫৯০ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

‘কুমিল্লা ইপিজেড চালুর পর থেকেই আমাদের দুঃখের শুরু। এরপর গত বিশ বছরের বেশি সময় ধরে সেই দুঃখ আর দুর্ভোগ শুধুই বেড়েছে। ইপিজেডের বিষাক্ত রাসায়নিক তরল বর্জ্যরে কারণে আমাদের এলাকার জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিষাক্ত তরল বর্জ্য এলাকার খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ও নদীতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। পঁচা ও বিষাক্ত দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির অবস্থাটা বর্তমানে এমন হয়েছে যে, একটি হাঁস এসব পানিতে সকালে নামলে বিকেলেই মারা যায়।’ দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ আর কষ্টের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন কুমিল্লা নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাসুদ আলম। শুধু মাসুদই নয়, এই সমস্যায় দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) তরল বর্জ্যে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশের বারোটা বেজে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। ইপিজেডের কল-কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য বেশ কয়েকটি খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ও নদীর পানিতে মিশছে। এতে ওইসব জলাশয় থেকে সকল প্রকার মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব খালে জলজ কোন প্রাণীরও দেখা মেলে না। এছাড়া ওইসব জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে যেসব এলাকায় ফসল উৎপাদন হতো, সেসব ফসলী জমির আবাদ এখন অনেকটাই হুমকির মুখে। অনেক এলাকায় কমে গেছে ফসলের উৎপাদনও। তবে কুমিল্লা ইপিজেড কর্তৃপক্ষের দাবি- তাদের কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারের মাধ্যমে সকল বর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে। তাদের কোন দূষিত বর্জ্য কোন জলাশয়ে মিশছে না।

এদিকে, দীর্ঘদিনের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কুমিল্লা ইপিজেডের আশে-পাশের এলাকার বাসিন্দাদের সংগঠন ‘কুমিল্লা জেলা কৃষক সমবায়ী ঐক্য পরিষদের’ নেতারা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনে এ নিয়ে এক সভা করেছেন তারা। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে সভায় অংশ নেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এছাড়া সভায় ইপিজেড এলাকার আশে-পাশের শতাধিক জমির মালিকও উপস্থিত ছিলেন। সভায় সংগঠনটির নেতারা দাবি করেন- দূষিত তরল বর্জ্যরে কারণে ব্যাহত হচ্ছে ৭১টি গ্রামের কৃষকদের ফসল উৎপাদন। তরল বর্জ্যরে কারণে মানুষের ক্ষতির পরিমাণ ৫৯০ কোটি। এই টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইপিজেড কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর জায়গা নিয়ে কুমিল্লা ইপিজেড প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০০০ সালের ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইপিজেডের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এই ইপিজেডে বিদেশি, দেশি এবং দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন মোট ৩৭টি কারখানা চালু রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর কুমিল্লা ইপিজেডে কোনো ধরণের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা হয়নি। সর্বশেষ স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইপিজেডের দক্ষিণ প্রান্তে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করার কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। বর্জ্য পরিশোধনাগারটি রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় পদ্ধতিতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে। ২৪ ঘণ্টাই এটি চালু থাকার কথা। এটি চালুর ফলে কুমিল্লা ইপিজেডের কারখানাগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই বর্জ্য পরিশোধনের সুযোগ পায়। তবে এরপরও বর্তমানে ওই ইপিজেডের তরল বিষাক্ত বর্জ্য কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশের বিভিন্ন ফসলি জমি, নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয়ে যাচ্ছে। এতে ফসলী জমির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। জলাশয় থেকে মরে গেছে মাছসহ সকল জলজ প্রাণী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কুমিল্লা নগরীর উনাইশার এলাকায় ইপিজেডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সীমানা প্রাচীরের নিচ দিয়ে বের হচ্ছে এসব বিষাক্ত পানি। প্রথমে পানিগুলো কিছুটা পরিস্কার থাকলেও কয়েক ঘণ্টা পরেই এগুলো কালো রঙের হয়ে যায়। এরপর পাশের দিশাবন্দ, কাজীপাড়া এলাকা দিয়ে এসব বিষাক্ত পানি সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর এলাকা হয়ে লালমাই উপজেলার বাগমারা এলাকায় গিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে মিশছে। এই বিশাল এলাকার প্রতিটি খাল-বিল ও নালার মধ্যে কালো রংয়ের পঁচা পানি। পানি থেকে পঁচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। এসব স্থান দিয়ে হাটা-চলাও দায় হয়ে পড়েছে।
কুমিল্লা জেলা কৃষক সমবায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ আখতার হোসাইন বলেন, ইপিজেডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তদারক করার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় একটি তদারকি কমিটি গঠন করে। আট সদস্যবিশিষ্ট বর্জ্য তদারকি কমিটিতে কোনো কৃষককে রাখা হয়নি। আমরা মনে করি- কুমিল্লা ইপিজেডের তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হলে বিমানবন্দর ও উনাইসার এলাকার খাল খনন করে দুই পাড়ে সীমানাপ্রাচীর করতে হবে।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর এলাকার জেলে মোরশেদ মিয়া স্থানীয় খালগুলো থেকে এক সময় অনেক মাছ ধরতেন বলে জানিয়েছেন। তবে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে খালে আর আগের মতো মাছ মিলছে না। এজন্য বর্তমানে তিনি বেড়জাল দিয়ে পুকুর ও বেড়িতে মানুষের চাষ করা মাছ ধরার কাজ করছেন।

কুমিল্লা নগরীর দিশাবন্দ এলাকার কৃষক জসিম উদ্দিনেরও কষ্টের শেষ নেই খালের পানি নিয়ে। কুমিল্লা সিটির মধ্যে পড়লেও দিশাবন্দ এলাকাটি এখনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মতোই। গত প্রায় ৩০ বছর ধরে চাষাবাদ করে আসা জসিম বলেন, আমাদের এলাকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল। ইপিজেড চালুর আগ পর্যন্ত আমরা খালের পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ করেছি। কিন্তু এক পর্যায়ে পুরো খালের পানি কালো রঙ ধারণ করে বিষাক্ত হয়ে গেলে আমাদের ফসল উৎপাদন অনেক কমে যায়। যার কারণে গত প্রায় ১৫ বছর ধরে এলাকার অধিকাংশ কৃষকই খালের পানি ব্যবহার করেন না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি ডা. মো. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইপিজেডের তরল বর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানি ফসল, মাছ ও মানুষের শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.শরীফ উদ্দিন বলেন, শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য পানিকে একেবারেই দূষিত করে ফেলে। তখন এসব পানিতে কোন মাছ বিচরণ এবং বংশ বিস্তার করতে পারে না। দূষণের কারনে ওই এলাকার খাল-বিল থেকে মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
৯ নভেম্বরের ওই সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ইপিজেডের তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি দেখতে চাই। আর খাল সংস্কারের ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, ইপিজেডের তরল বর্জ্যরে কারণে খালের মধ্যে গন্ধ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা করেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া কুমিল্লা নগরীর ময়লা পানিও ড্রেনের মাধ্যমে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে।
৯ নভেম্বরের ওই সভায় এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কুমিল্লা ইপিজেডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, শুধুমাত্র ইপিজেডের তরল বর্জ্যরে কারণে খাল, পুকুর ও টিউবওয়েলের পানি কালো হচ্ছে না। কুমিল্লা বিমানবন্দরের রানওয়ের ভেতরে গরুর খামার আছে। এই খামারের গরুর মূত্রও খালে যাচ্ছে। এছাড়া কুমিল্লা নগরীর বর্জ্যও যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। আর মাঝেমধ্যে টেকনিক্যাল কারণে শোধনাগারে ঝামেলা হচ্ছে। তবে আমাদের কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারটি ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। এতে ইপিজেডের সকল বর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে।