কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের ইতিহাস ও প্রথম দুইভাগ হওয়ার কারণ নিয়ে যা বললেন গবেষক আহসানুল কবির

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

জাহিদ হাসান নাইম ।।

গবেষক ও সংগঠক আহসানুল কবির সম্প্রতি জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিন এর সাথে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন কুমিল্লা জেলার ছাত্রলীগের ইতিহাস ও জেলায় প্রথম ছাত্রলীগের বিভক্তির কারণ। আলোচনায় যুক্ত হয় সমসাময়িক রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ও।

গবেষক আহসানুল কবির বলেন, ছাত্রলীগের ক্যানভাসটি অনেক বিস্তৃত। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের এসেম্বলি হলে বাঙ্গালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের উদ্যোগে নাইমুদ্দিন আহমেদকে আহবায়ক করে ছাত্রলীগের যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়, তার কিছুদিন পরেই কুমিল্লাতেও ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন কুমিল্লা জেলার নাম ছিলো ত্রিপুরা। তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র নোয়াখালী নিবাসী বজলুল হায়দার ও এডভোকেট আহমেদ আলীর নেতৃত্বে কুমিল্লায় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে।

এর কিছুদিন পরে, বজলুল হায়দার শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশের বাহিরে চলে যাওয়ায়, এডভোকেট আহমেদ আলীর নেতৃত্বে ‘ত্রিপুরা জেলা ছাত্রলীগ’ নামে কমিটি গঠন করা হয়। তখন এই ছাত্রলীগ তমুদ্দিন মজলিশ এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁওয়ের নূরুল ইসলাম খাঁন । সাবেক এম এন এ নুরুল ইসলাম খান বর্তমানে দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক- সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের বাবা। তিনি ছিলেন কুমিল্লা তথা তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা ছাত্রলীগের তৃতীয় সভাপতি। পরবর্তীতে সভাপতির পদে আসীন হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র তাহের উদ্দিন ঠাকুর। তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হয়। তখন এর ফলে, ছাত্রলীগের রাজনীতি সহ সকল গণতান্ত্রিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে ত্রিপুরার নাম পরিবর্তন করে ‘কুমিল্লা’ নামকরণ করা হয় এবং আইয়ুব খানের রাজনীতি করার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এতে করে কুমিল্লাতেও পুনরায় ছাত্রলীগের কার্যক্রম চালু হয়। তখন ১৯৬০ সালের শেষদিকে বা ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৎকালীন বৃহত্তম কুমিল্লা জেলায় (চাঁদপুর, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা) ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি সভাপতি ছিলেন লাকসাম নিবাসী মুজিবর রহমান, সহ-সভাপতি হোন ঢুলিপাড়ার একেএম মাহবুবুল হক ও মুন্সেফ বাড়ির হাবিবুল্লাহ চৌধুরী।সাবেক যুবমন্ত্রী পালপাড়া নিবাসী আবুল কাসেম কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হন। তখন মুজিবর রহমান ও মাহবুবুল হক শিক্ষাসূত্রে কুমিল্লার বাহিরে চলে যাওয়ায় হাবিবুল্লাহ চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে হাবিবুল্লাহ চৌধুরীকে সভাপতি, ও তৎকালীন তুখোড় ছাত্র নেতা ও প্রবীণ আইনজীবি এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির নেতৃত্বেই তৎকালীন শিক্ষা-কমিশন বিরোধী তীব্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে।

পরবর্তীতে ১৯৬৩ সাল বা তারও পরে কমিটিতে সভাপতি পদে নির্বাচিত হোন অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হোন বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান বাবলু। পরবর্তী কমিটিতে সভাপতি হয় সৈয়দ রেজাউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হন বাগিচাগাঁও নিবাসী আলী ইমাম। পরবর্তীতে যে কমিটি দেওয়া হয় তা খুব স্বল্প সময়ের জন্য ছিলো। এ কমিটিতে সভাপতি হন আলী ইমাম ও সাধারণ সম্পাদক হন মাইনুল হুদা। ইতিমধ্যেই শুরু হয় ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। এসময় ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি পদে আসেন মোগলটুলি নিবাসী ও সাসেক এমপি আনসার আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন বিষ্ণুপুর নিবাসী ও ৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক দুলাল। এর পরবর্তী কমিটিতে সভাপতি হন মোগলটুলি নিবাসী ও কুমিল্লা জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি এড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ পিন্টু ও সাধারণ সম্পাদক হোন তৎকালীন ভিক্টোরিয়া কলেজের জিএস এড. রুস্তম আলী। এই কমিটি থাকাকালীন সময়েই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিক ভাবে দুইভাগ হয়ে যায়। তখন ছাত্রলীগের অফিস ছিলো বাদুরতলা চৌধুরী মার্কেট। সে সময় সৈয়দ আব্দুল্লাহ পিন্টু ও শিব নারায়ণ দাসের নেতৃত্বে জাসদ ছাত্রলীগ গঠিত হয়। এটি ছিলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে। তাতে মূল কমিটির ১৭ জন বাদে বাকী সবাই এক দিকে চলে যায়। অপরদিকে রুস্তম আলী ও তৎকালীন ভিক্টোরিয়া কলেজের জিএস আকবর কবীর সহ বাকী অংশ থেকে গেলেন মুজিববাদী ছাত্রলীগে। সেসময় নাজমুল হাসান পাখি কে আহবায়ক করে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়।

সেই আহবায়ক কমিটি তিন মাসের মধ্যেই কমিল্লা টাউনহল মাঠে দুইদিনের একটি সম্মেলন করেন। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধান মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। সেই সম্মেলনে রুস্তম আলীকে সভাপতি ও আকবর কবীর কে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিববাদী ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বঙ্গবন্ধুর সাথে যে বিয়োগান্তক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিলো সেই সময়ে এই কমিটির সদস্যদেরকে অনেক অত্যাচার করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে আবারো ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তখন কুমিল্লাতে আওয়ামীলীগ কঠিন দুটি ভাগে বিভক্ত ছিলো। সেই সম্মেলনে দুইটি কমিটি হয়। একটি কমিটি ছিলো কাজী আবুল বাশার ও আনিসুল ইসলামের নেতৃত্বে। অপর কমিটি ছিলো খুব সম্ভবত আজিজুর রহমান হুমায়ুন ও জহিরুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে। তার পরের ইতিহাস কমবেশ আমাদের সবার ই জানা।”

এসময় বর্তমান ছাত্রলীগের সাথে অতীত ছাত্রলীগের তুলনা জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আহসানুল কবীর বলেন ‘যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে এর মধ্যে।’ তিনি আরো বলেন, “ছাত্রলীগের আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রামের ফসল ছিলো আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। ছাত্রলীগের ইতিহাস হচ্ছে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস। দেশ বরেণ্য নেতৃবৃন্দ এই ছাত্রলীগ থেকেই তৈরী হয়েছে, তৈরী হয়েছিলো অসংখ্য বুদ্ধিজীবিও। ছাত্রলীগ কাজ করবে মানুষের জন্য, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য।

আমরা কখনো ভাবতাম না যে ছাত্রলীগ করে আমরা লাভবান হবো, সুবিধা ভোগ করবো। আমাদের স্বপ্ন ছিলো দেশ গড়া। দেশের জন্য কিছু করা। আমাদের সময়কার ছাত্রলীগের জন্য আমি যে গর্ববোধ করি, আজকের দিনের ছাত্রলীগের যে অবক্ষয় তার জন্য আমি লজ্জিত বোধ করি। আমি আশা করি, কোনো এক সোনালী ভোরে জিয়ন কাঠির স্পর্শে ছাত্রলীগ আবারো ফিনিক্স পাখির ন্যায় জেগে উঠবে। ছাত্রলীগ আবারো তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে। দেশ ও জাতির গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে, অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে ছাত্রলীগ আবার নেতৃত্ব দিবে।

লেখক : গবেষক, সংগঠক ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা।