“আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ”-এই সত্যটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু ক’জনই বা শিশুর কৌতূহল, স্বপ্ন কিংবা অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারি? এমনই এক মন ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনার সাক্ষী হল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিকেলবেলা।
ইমন ও ফারহান, বয়স বড়জোর ছয় কিংবা সাত। পড়ালেখা করে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ‘জামিয়া মোহাম্মাদিয়া তা’লিমুল কুরআন মাদ্রাসা’ নামে একটি মাদ্রাসায়। প্রতিদিন তারা দেখত বিশাল ক্যাম্পাস, উঁচু গাছগাছালি, আর দূর থেকে নজরে পড়া সেই ওয়াচ-টাওয়ার, যেটি তাদের চোখে যেন এক রহস্যময় দুর্গ। কৌতূহল আর স্বপ্ন নিয়ে তারা আজ বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে। লক্ষ্য ওয়াচ-টাওয়ারে একবার উঠবে।
কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে আনসার সদস্য তাদের প্রথমে বাধা দেন। সেই বাধা অবশ্য খারাপ উদ্দেশ্যে নয়; দুই ছোট্ট শিশুর নিরাপত্তাই ছিল প্রধান বিবেচ্য। আনসার মামার দৃষ্টিভঙ্গি দায়িত্বশীলতার পরিচয় বটে, তবে শিশুদের মুখে হতাশার ছায়াও স্পষ্ট ছিল। আশাহত হয়ে তারা ক্যাম্পাসের ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মনে ফিরে আসে ছোটবেলার স্মৃতি। সেই সময়, যখন সামান্য কিছু দেখাও ছিল এক বিশাল অভিজ্ঞতা। শিশুকালের সেই আবেগ অনুভব করে ইমন ও ফারহানকে ডেকে ওয়াচ-টাওয়ারেট উপরে ওঠার কথা জিজ্ঞেস করতেই তাদের মুখ থেকে হতাশার ছাপ উধাও হয়ে আসে নিষ্পাপ হাসি, সানন্দে সম্মতি জানায়। তারপর মস্তিষ্কে অসংখ্য কৌতূহল নিয়ে তারা উঠে যায় ওয়াচ-টাওয়ারের ওপর।
ওপরে উঠেই শুরু হয় তাদের নানা কৌতূহলি প্রশ্ন। তাদের ভাবনার জগতের আকাশে যেন কালবৈশাখী ঝড় ওঠে, সেই আকাশে যেন মেঘ জমেছে এবং তাদের প্রশ্নগুলো যেন মেঘের বুক চিরে বের হওয়া একেকটা বৃষ্টির ফোটা। প্রশ্নের যেন আর শেষ নেই।
ওই ছোট্ট যাত্রা যেন দুই শিশুর জীবনে এক আনন্দ বিস্ফোরণ ঘটায়। উপরে উঠে তারা আবিষ্কার করে নতুন এক পৃথিবী, নীল আকাশ যেন আরও কাছাকাছি, দূরের গাছগুলো যেন হাত ছুঁতে পারা যায়, ক্যাম্পাস যেন এক বিশাল রাজ্য! আনন্দে আত্মহারা হয় তারা। চোখে মুখে উচ্ছ্বাস, কণ্ঠে আহ্লাদ, এবং হৃদয়ে যে একটুকরো স্বপ্ন, যা হয়তো সারাজীবন স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে।
এই ছোট্ট ঘটনা বড় একটি বার্তা দেয়। আমাদের সমাজে শিশুদের নিরাপত্তার সাথে সাথে তাদের মানসিক বিকাশ ও আনন্দের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। একটি ছোট অভিজ্ঞতা যেমন একটি ওয়াচ-টাওয়ারে ওঠা, তাদের কল্পনাকে প্রসারিত করতে পারে, আত্মবিশ্বাস জোগাতে পারে এবং ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
আমাদের উচিত এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে শিশুদের কৌতূহলকে দমন না করে তাকে নিরাপদ সীমার মধ্যে উন্মুক্ত রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। যেখানে অভিভাবক, শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মী সবাই মিলে একটি সহনশীল, ভালোবাসায় ভরা পরিবেশ তৈরি করবে, যাতে প্রতিটি শিশু তার স্বপ্নকে ছুঁতে পারে।
ইমন ও ফারহান শুধু দুটি নাম নয়, তারা এই সমাজের অসংখ্য শিশুর প্রতিচ্ছবি। যারা একটু সুযোগ পেলে তাদের চোখের তারা হয়ে উঠতে পারে আগামীর দীপ্ত তারকা।